সারা বিশ্বে মহামারি হিসেবে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসে এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ২৯ লাখের বেশি মানুষ। মৃতের সংখ্যা দুই লাখ ছুঁইছুঁই।
করোনা প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত রাখার পরও হিমশিম খাচ্ছে উন্নত দেশগুলো। তেমনি কয়েকটি দেশ করোনা মোকাবিলায় দেখিয়েছে দারুণ সাফল্যও। তবে করোনার মহামারি ঠেকাতে পুরুষ নেতৃত্বের থেকে এগিয়ে রয়েছে নারী নেতৃত্ব। বিশ্বের নারী নেতৃত্বে পরিচালিত কয়েকটি দেশ করোনার সংক্রমণ রোধে ইতিমধ্যে দারুণ প্রশংসিত হয়েছে।
বিশ্বজুড়ে করোনা মোকাবিলায় সেই ক্ষমতাসীন সফল নারী নেতৃত্ব ও তাদের দেশের গল্প নিয়েই বার্তার এ আয়োজন।
সারা বিশ্বে যখন করোনার প্রাদুর্ভাব বেড়ে চলছে ক্যারিবিয়ান দ্বীপ রাষ্ট্র সিন্ট মার্টিনের প্রধানমন্ত্রী সিলভিয়া জ্যাকব নড়েচড়ে বসলেন। ৪১ হাজার ৫০০ জনসংখ্যার অধ্যুষিত দেশটিতে প্রতি বছর ৫ লাখ পর্যটক আসে, করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব বাড়ায় তাদের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকির হবে। সেই সঙ্গে দেশটিতে মাত্র ২টি আইসিইউ বেড।
তবে জ্যাকব লকডাউন চাননি, তাই তিনি সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাকে কাজে লাগালেন। ঘোষণা দিলেন, মানুষের চলাফেরা একবারেই বন্ধ! জনগণকে বললেন, যদি আপনার ঘরে রুটি না থাকে, তাহলে ক্র্যাকার্স খান, ভাত ও অটস খান। ঘর থেকে বের হবেন না।
৫১ বছর বসয়ী এই ক্যারিবিয়ান প্রধানমন্ত্রী অ্যাঞ্জেলা মার্কেল ও জেসিন্ডা আর্ডার্নের মতো বৈশ্বিক পরিচিতি নেই, কিন্তু তার এই বার্তা কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। যা অন্য ক্ষমতাসীন নারী নেত্রীদেরও করোনাভাইরাস মোকাবিলায় পথ দেখিয়েছে।
জার্মান থেকে নিউজিল্যান্ড এবং ডেনমার্ক থেকে তাইওয়ানের ক্ষমতাসীন নারীরা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তার দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে সফলতা দেখিয়েছে। ভিয়েতনাম, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুরের নেতারাও করোনা প্রতিরোধে ভালো করেছে তবে নারী নেতাদের থেকে তুলনামূলক কম।
নিউজিল্যান্ডের ৩৯ বছর বয়সী প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আর্ডার্ন, লকডাউন ঘোষণা করে তার জনগণকে বলেছেন, ঘরে থাকুন, জীবন বাঁচান। এছাড়া প্রতিদিন তিনি ফেসবুক লাইভে এসে জনগণের উদ্দেশে বক্তব্য দিয়েছেন।
প্রথমে তার পদক্ষেপ ছিল অনুরোধ এবং সহানুভূতিশীল মনোভাব। তিনি বলেন, আপনার প্রতিবেশির দিকে খেয়াল রাখুন, অসহায়ের প্রতি দৃষ্টি দিন এবং খাবার সংগ্রহে অন্যের জন্য কিছু ত্যাগ করুন- ফেসবুক লাইভে এসে আর্ডার্নের দেওয়া এসব বক্তব্য তার ভক্তরা শেয়ার করেন, এভাবে গোটা দেশকে ঐক্যবদ্ধ করেন তিনি।
পরবর্তীতে আর্ডার্ন কঠোর ও দ্রুত পদক্ষেপের উপর জোর দিয়েছিলেন। দেশটিতে যখন ১৫০ জন মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত, কোন মৃত্যু ছিলো না সে সময় তিনি দেশবাসীকে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বলেছিলেন। বিশ্বের অন্য দেশ থেকে ১৪ মার্চ পর্যন্ত নিউজিল্যান্ডে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। এখন পর্যন্ত নিউজিল্যান্ডে করোনায় মাত্রা ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর্ডার্ন সরকারের উপর নিউজিল্যান্ডের ৮০ শতাংশের মানুষের আস্থা রয়েছে।
জার্মানির চ্যান্সেলর আঞ্জেলা মার্কেলের করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে নেওয়া তার পদক্ষেপগুলো বেশ প্রশংসিত হয়েছে। তিনি প্রাদুর্ভাবের শুরুতে সবাইকে সতর্ক করেছিলেন জার্মানির ৭০ শতাংশ নাগরিক এ ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন। করোনার কারণে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের থেকেও খারাপ পরিস্থিতি ধারণ করতে পারে বলে জানিয়েছিলেন।
কোভিড-১৯ মোকাবিলায় জার্মান নাগরিকদের শুরু থেকে প্রচুর টেস্ট করোনা হয়, পর্যাপ্ত আইসিইউ বেডের ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। চ্যান্সেলর শুরু থেকে জনগণকে এর ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন করেছেন। করোনায় আক্রান্ত হয়ে জার্মানিতে ৫ হাজার লোক মারা যায়, মার্কেলের সময়োচিত পদক্ষেপের কারণে যা অন্য ইউরোপীয় দেশের তুলনায় অনেক কম।
সরকারের লকডাউন সিদ্ধান্ত জনগণ যাতে ভালোভাবে নেন, এজন্য আঞ্জেলা মার্কেল করোনাভাইরাস কিভাবে মানুষকে সংক্রমিত ও ক্ষতি করে তার একটি বৈজ্ঞানিক ভিডিও চিত্র তৈরি করেন। ওই ভিডিওটি অনলাইনে হাজারের বেশি শেয়ার হয় এবং জার্মান নাগরিকরা এর প্রশংসা করেন। মনে করা হয়, চ্যান্সেলরের এ উদ্যোগে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে ৭০ শতাংশ কাজে দিয়েছে।
ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডারিকসেন করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে দ্রুত পদক্ষেপ নেন। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশটি ১৩ মার্চ থেকে তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দেন। ওই দিন থেকে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করেন। একসঙ্গ ১০ জনের বেশি মানুষ জড়ো হওয়ায় নিষেধাজ্ঞা প্রদান করেন।
ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রীর দ্রুত নেওয়া সিদ্ধান্ত দেশটিকে মহামারি পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করেছে। ডেনমার্কে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৮ হাজারের কম এবং মৃত্যুবরণ করেছেন ৩৭০ জন। করোনা মোকাবিলায় ফ্রেডারিকসেনের পরিষ্কার নির্দেশনামূলক বক্তব্য বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে।
লকডাউনের সময়ে দেশের জনগণকে আনন্দ দিতে ডেনিশ প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন আনন্দদায়ক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকে জড়ান। নিজের রান্না করা ও ড্যানিস পপ স্টার ডুডোর আশির দশকের জনপ্রিয় গানগুলো গেয়ে-সেগুলোর ভিডিও ফেসবুকে শেয়ার করেন। এসব কারণে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশটির কম বয়সী এই প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রিয়তা বেড়ে দ্বিগুণ, ফলে তার জন্য জনগণকে লকডাউন মানাতে সহজ হয়েছে।
চীনের মূল ভূখণ্ডের বাইরে যখন নভেল করোনাভাইরাস খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছিল ২৫ জানুয়ারি বিশ্বের অনেক দেশই এর ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে পারেনি। চীনের মূল ভূখণ্ডের বাইরে অস্ট্রেলিয়া ও তাইওয়ান তাদের সীমানায় চারজন করোনা রোগী শনাক্ত করে। চীনের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে তাইওয়ানের শক্তিশালী বাণিজ্য ও পরিবহন যোগাযোগ রয়েছে। শুরুতে করোনা সংক্রমণ হলেও তাইওয়ান এই ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে যা বিশ্বের অন্য দেশগুলো পারেনি।
তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট তাসি ইং ওয়েন করোনাভাইরাস মোকাবিলায় দ্রুত কার্যকরি পদক্ষেপ নেওয়া নেন, এ কারণে ঝুঁকিপূর্ণ হয়েও মহামারি থেকে দেশটি রক্ষা পায়। জনস্বাস্থ্য রক্ষায় তাইওয়ান সপ্তাহে অন্তত ১২৪টি অ্যাকশন আইটেম তৈরি করেছে এবং তা বাস্তবায়ন করেছে। তাইওয়ানের নেওয়া ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে ছিল চীনের অনেক অঞ্চল থেকে ভ্রমণ নিষিদ্ধ করা, দ্বীপটির বন্দরগুলোতে প্রমোদতরী নোঙর বন্ধ করা এবং যে কেউ হোম কোয়ারেন্টিনের নিয়ম ভঙ্গ করলে কঠোর শাস্তি প্রদান।
করোনাভাইরাস প্রতিরোধ এবং এর বিস্তার ঠেকাতে শুরুতেই কঠোর পদক্ষেপ নেন ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সান্না মারিন। তার সমায়োচিত পদক্ষেপের কারণে ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় ফিনল্যান্ডে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত ও মৃতের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। যে সমস্ত বিধিনিষেধ ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয়েছিল তা পর্যায়ক্রমে শিথিলের ইঙ্গিত দিয়েছেন ফিনিস প্রধানমন্ত্রী।
করোনাভাইরাস ঠেকাতে রাজধানী হেলসিংকিসহ দক্ষিণ ফিনল্যান্ডের সঙ্গে সারাদেশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছিলেন। এছাড়াও আন্তর্জাতিক রুটে বিমান চলাচলের বিধিনিষেধ আরোপ ও রেস্ট্রুরেন্ট, অফিস-আদালত ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি বন্ধ ঘোষণা করেছিলেন।
দেশটিতে প্রাণঘাতী করোনায় মৃতের সংখ্যা ১৪১ জন। ফিনল্যান্ডে এ পর্যন্ত ৬১ হাজার ৮০০ জনকে করোনাভাইরাস সংক্রমণের পরীক্ষা করে ৪ হাজার ১৪ জনের মধ্যে করোনা শনাক্ত হয়েছে। ফিনিস প্রধানমন্ত্রী করোনার প্রভাবে যারা সাময়িকভাবে চাকরিচ্যুত অথবা ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের জন্য আর্থিক সহায়তার ঘোষণা দিয়েছেন।
সূত্র: গার্ডিয়ান