ভারত মহাসাগরে যখন ঘূর্ণিঝড় আম্পান দানা বাধা শুরু করে, তখন নষ্ট করার মত কোন সময় বাংলাদেশের হাতে একেবারেই ছিল না। কিন্তু এদেশের আশ্রয়কেন্দ্রগুলি সামাজিক দূরত্বের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে নির্মিত হয়নি। ফলে বেশ বড় ধরণের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে দেশটিকে।
দুর্যোগপূর্ণ এলাকার মানুষজনদের সরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল সময়। জনগণ নিজেদের ঘরবাড়িকে অরক্ষিত অবস্থায় ছেড়ে যেতে চান না। এর সঙ্গে এবারের চ্যালেঞ্জ ছিল আরও জটিল। মানুষজন করোনাভাইরাসের আতঙ্কে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার ব্যাপারে ভীত হয়ে পড়ছিল।
বাংলাদেশে অল্প কিছু দিনের মধ্যে ৪১৭১টি আশ্রয় কেন্দ্রের পাশাপাশি প্রায় ১০,৫০০টি অতিরিক্ত আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয় যেন সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সবাইকে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়। এ সময়ে উপকূলীয় অঞ্চল জুড়ে ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতিতে অংশ নেওয়া ৭০,০০ এরও বেশি স্বেচ্ছাসেবী একত্রিত হয়। মাস্ক, পানি, সাবান এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিতরণ করা হয় সবার মাঝে। এক্ষেত্রে পোশাক শিল্প ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জাম উত্পাদন করে সহায়তা করেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওশনিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফিয়ারিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন থেকে আগেই জানানো হয়, আটলান্টিক এবং ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে পানির তাপমাত্রা অস্বাভাবিক গরম হওয়ার কারণে এই বছরের ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষেত্রে রেকর্ড তৈরি হতে পারে।
ঘূর্ণিঝড় আম্পানের ফলে ভারত এবং বাংলাদেশে মারা গেছেন ১০০ জনেরও কম মানুষ। বলা হচ্ছে কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের প্রাথমিক সতর্কতা ব্যবস্থা এবং দারুণ উদ্ধার কার্য বাঁচিয়ে দিয়েছে কয়েক হাজার মানুষকে।
পূর্বে বহুবার ঘূর্ণিঝড়ের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ পুনরায় উঠে দাঁড়িয়েছে। গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঝড়ের ঝুঁকিতে থাকা বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ বাংলাদেশের ভূমি দুই-তৃতীয়াংশ সমুদ্রপৃষ্ঠের ৫ মিটারেরও কম উপরে অবস্থিত। ফলে এদেশে পুনঃনির্মাণ খুব কঠিন কোন কাজ নয়। তবে ঘূর্ণিঝড় আরও বেশি তীব্র হয়ে দেখা দেওয়ায় সমুদ্রের পানির মাত্রা বেড়ে পানির কূপ ও চাষের আবাদ বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। মহামারী এবং ঘূর্ণিঝড়ের ফলস্বরূপ বর্তমান বাংলাদেশ সরকারকে স্বাস্থ্য, জলবায়ু এবং অর্থনৈতিক জরুরী পরিস্থিতি একসাথে মোকাবেলা করতে হবে।
উত্তর ভারত মহাসাগরের রেকর্ডে সবচেয়ে ব্যয়বহুল ঘূর্ণিঝড় হল আম্পান। এবং এতে ধ্বংসের আনুমানিক পরিমাণ হল ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশে এই ঘূর্ণিঝড় ৪১৫ কিলোমিটার রাস্তা, ২০০টি সেতু, কয়েক হাজার ঘরবাড়ি, বিশাল জমি এবং মাছের আবাদের উপর প্রভাব ফেলে। ঝড়ের তীব্রতা রক্ষার জন্য ১৫০ কিলোমিটারেরও বেশি বাঁধ ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
২০১৪ সালে জলবায়ু আর্থিক কাঠামো কার্যকর করার জন্য বাংলাদেশকে আরও ভালোভাবে পুনর্গঠন করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে আট শতকের জলবায়ু অভিযোজন পরিকল্পনা তৈরি করা হয় ডেলটা অঞ্চলের ৩০ মিলিয়ন ব-দ্বীপ অঞ্চলের বাসিন্দাদের জন্য। যার মাঝে প্রথম দশক হল ডেলটা প্ল্যান ২১০০, যার মূল লক্ষ্য কাঠামোকে শক্তিশালী করা, যেমন- উঁচু দালান নির্মাণ। আম্পান ঘূর্ণিঝড়ের পরবর্তী সময়ে স্কুল, হাসপাতাল ও ঘরকে আরও শক্ত ও মজবুতভাবে তুলতে হবে। যেন ঘূর্ণিঝড়ের বিরুদ্ধে তা প্রতিরোধমূলক কাজ করতে পারে।
কোভিড-১৯ পুরো বিশ্বের সরকারের আর্থিক অবস্থার উপর বড় ধরণের নেতিবাচক প্রভাব ফেলে দিয়েছে। তবে আশা করা যায় দীর্ঘমেয়াদী আর্থিক কাঠামো এবং জলবায়ু অভিযোজন পরিকল্পনার ফলে যেকোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভালোভাবে সাড়া দেওয়ার ব্যবস্থা প্রতিটি দেশেরই থাকে। স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক এবং জলবায়ুর পরিবর্তন একে অন্যের সঙ্গে আন্তঃসম্পর্কিত।
এই বছরে শুধু বাংলাদেশই স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক ও জলবায়ু সংক্রান্ত জরুরি অবস্থার সাথে লড়াই করছে না। সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের প্রতিটি দেশ থেকে সাফল্যের বিষয়গুলো শিখে একে-অপরকে সমর্থন করার মাধ্যমে আরও বেশি দৃঢ়তা লাভ করা সম্ভব।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান