করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) কারণে অনেকটা টালমাটাল অবস্থায় সারাবিশ্ব। শনাক্তের ৩ মাসের মধ্যেই এটিকে বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে ঘোষণা দেয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। মাত্র তিনটি মাসে আক্রান্ত আর মৃত্যুর অংকের মাধ্যমে ভয়ঙ্করভাবে নিজের অবস্থান জানান দেয় ভাইরাসটি।
করোনার দাপটে আক্রান্ত ও বিভ্রান্ত সারাবিশ্ব। এর আগে পৃথিবীতে বেশ কয়েকটা মহামারি এসেছিলো। এগুলোর মধ্যে বসন্ত, প্লেগ, স্প্যানিশ ফ্লু, কলেরা মানব সভ্যতাকে যথেষ্ট ভুগিয়েছে। কিন্তু সময় লাগলেও প্রতিভাবান মানবজাতি প্রায় প্রতিটি যুদ্ধেই বিজয়ী হতে পেরেছে। বিজ্ঞানের অপরিসীম অবদানে সফল হয়েছে ভ্যাকসিন তৈরিতে। তেমনি করোনার ভ্যাকসিন তৈরিতেও কাজ করছে ২শটিরও বেশি প্রতিষ্ঠান। ইতিমধ্যেই অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান বেশকিছু আশা জাগানো কথাও শুনিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মডার্নার তৈরি এমআরএনএ-১২৭৩ নামের করোনাভাইরাস ভ্যাকসিনটির প্রথম ডোজ গত ১৬ মার্চ এক স্বেচ্ছাসেবীর শরীরে প্রবেশ করানো হয়। মূলত সার্স ও মার্সের ওপর পরিচালিত গবেষণার ওপর ভিত্তি করে এই ভ্যাকসিনটি তৈরি করা হয়। পরীক্ষার ফলাফলে ভ্যাকসিন তৈরিতে নিজেদের অনেকটা সফল বলেই দাবি করছে প্রতিষ্ঠানটি।
গত ১মে যুক্তরাজ্যের বৃহৎ ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন উৎপাদনকরতে অক্সফোর্ডের সঙ্গে কাজ শুরু করে। ইতিমধ্যেই অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তৈরি করোনার এনকোভ-১৯ নামক ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ট্রায়ালও শুরু হয়ে গেছে। জুনের মধ্যেই এর কার্যকারিতা জানা যাবে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এটি কার্যকর হলে সেপ্টেম্বরের মধ্যে এক মিলিয়ন ডোজ ভ্যাকসিন উৎপাদন করার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে গবেষকরা। প্রথম ট্রায়ালে নিজেদের সফল দাবি করে এবার ৮০ ভাগ সাফল্যের বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী তারা।
এবার আসা যাক চীনের কথায়। করোনার উৎপত্তিস্থল এই দেশটি ভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কারে আশার আলো দেখাচ্ছে। বেইজিং ভিত্তিক বায়োটেকের সংস্থার তৈরি সিনোভ্যাকের ভ্যাকসিনটি নাকি সম্পূর্ণ নিরাপদ ও পরীক্ষায় ৯০ শতাংশ ইতিবাচক ফল দিয়েছে। এমনকি রাশিয়াও তাদের একটি ওষুধের মাধ্যমে করোনা মোকাবিলার করেছে বলে তারা দাবি করেছে।
চীন বলছে, সিনোভ্যাকের করোনা ভ্যাক টিকা মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। ইতিমধ্যে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে এটি দুই সপ্তাহের মধ্যে শরীরে কার্যকর অ্যান্টিবডি তৈরিতে সক্ষম হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষা শেষে এবার ব্রাজিলে হবে তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা। বেইজিং ভিত্তিক বায়োটেক সংস্থাটি ইতিমধ্যেই ১০ কোটি ভ্যাকসিন ডোজ সরবরাহের লক্ষ্যে কাজ করছে।
এদিকে জার্মানিতে চলছে করোনাভাইরাসের জন্য দুটি ভ্যাকসিনের কাজ। গত এপ্রিল মাসে মার্কিন কোম্পানি ফাইজারের সঙ্গে কাজ করা জার্মানির 'বায়নটেক' কোম্পানিকে সর্ব প্রথম ভ্যাকসিন গবেষণার অনুমোদন দেয়া হয়। এর পর গত সপ্তাহে জার্মানির 'কিওরভ্যাক' কোম্পানিকে তাদের উদ্ভাবিত করোনার টিকা মানবদেহে পরীক্ষার অনুমতি দেয়া হয়েছে। কোম্পানিটি প্রথমে ১৬৮ জন স্বেচ্ছাসেবীর উপর পরীক্ষা চালাবে। এই মাসেই ১৪৪ জন স্বেচ্ছাসেবীকে টিকা দেয়া হবে৷ প্রাথমিক ফল সন্তোষজনক হলে সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরে আরও বড় পরিসরে পরীক্ষা শুরু হবে।
করোনা লড়াইয়ে যুক্তরাজ্যে ট্রায়ালে সুফল মিলেছে ডেক্সামেথাসোন নামের কমদামী ও সহজলভ্য এই ওষুধটি। বলা হচ্ছে, কোভিড হানায় অত্যন্ত সংকটজনক রোগীকেও সুস্থ করে দিতে পারে এই ওষুধ। আসলে এটি একটি স্টেরয়েড। যা শরীরে ইনফ্লামেটারি হরমোন উৎপাদনের মাধ্যমে কাজ করে। তবেপ্রাণ বাঁচাতে সহায়তা করতে সক্ষম স্টেরয়েড ডেক্সামেথাসোন কেবল গুরুতর কোভিড-১৯ রোগীদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা উচিত বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।
যুক্তরাজ্যের বিশেষজ্ঞরা বড় ধরনের ট্রায়াল শেষে গত সপ্তাহের মঙ্গলবার ঘোষণা করে, সস্তা ও সহজলভ্য কম মাত্রার স্টেরয়েড ডেক্সামেথাসোন ভেন্টিলেটর সাপোর্টে থাকা রোগীদের মৃত্যুর ঝুঁকি এক তৃতীয়াংশ এবং অক্সিজেন সাপোর্টে থাকা রোগীর মৃত্যুর ঝুঁকি এক-পঞ্চমাংশ কমায়, যা মারাত্মক এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বড় অগ্রগতি।
এদিকে সোমবার (২২ জুন) পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী বিশ্বে করোনাভাইরাস সংক্রমণে আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৯০ লাখ। এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৪ লাখ ৭০ হাজারের কাছাকাছি। তবে আশার কথা হচ্ছে, এরই মধ্যে চিকিৎসা নিয়ে করোনা থেকে সুস্থ হয়ে উঠেছেন ৪৮ লাখ ৩৩ হাজার ৫২১জন। চলতি বছরের শেষ নাগাদ এর ভ্যাকসিন তৈরি হওয়ার কথা থাকলে তা আদৌ সম্ভব কিনা বলা মুশকিল।