কোরআন-হাদিসের ভাষ্যমতে, যারা দুনিয়াতে পিতা-মাতাকে সন্তুষ্ট করতে পেরেছে; দুনিয়া ও পরকালে তারা সফল। আর যারা দুনিয়াতে পিতা-মাতার সন্তুষ্টি অর্জনে ব্যর্থ, তাদের দুনিয়া ও পরকাল উভয়টিই ব্যর্থ।
পৃথিবীতে যত মানুষ আছে তাদের মধ্যে যাদেরকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া উচিত তারা হলেন- পিতা-মাতা। আল্লাহতায়ালা পিতা-মাতাকে এই সম্মান প্রদান করেছেন। পিতা-মাতার অবাধ্য হয়ে লোকসমাজে বড় বুজুর্গ হিসেবে পরিচিত হলেও কোনো লাভ হবে না। কারণ পিতা-মাতার অবাধ্য ও অকৃতজ্ঞ সন্তানের কোনো ইবাদতই আল্লাহ কবুল করেন না।
পিতা-মাতার মর্যাদা সম্পর্কে কোরআন-হাদিসের নির্দেশনা
পিতা-মাতার মর্যাদা সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহতায়ালা নির্দেশ প্রদান করে বলেছেন, ‘আমার কৃতজ্ঞতা এবং তোমার পিতা-মাতার কৃতজ্ঞতা আদায় করো।’ -সূরা লোকমান: ১৪
‘তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তিনি ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করবে না এবং পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করবে; তাদের একজন অথবা উভয়েই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলেও আদেরকে বিরক্তিসূচক কিছু বলো না এবং তাদেরকে ভৎর্সনা করো না। তাদের সঙ্গে কথা বলো সম্মানসূচক নম্র কথা।’ -সূরা বনি ইসরাঈল: ২৩
হজরত আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহ আনহু বর্ণনা করেন, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘জান্নাতের হাওয়া পাঁচশত বছরের পথ অতিক্রম করে আসে। কিন্তু উপকার করার পর যে খোটা দেয়; পিতা-মাতার অবাধ্য ব্যক্তি এবং মদপানে অভ্যস্ত ব্যক্তি এ হাওয়ার পরশটুকুও পাবে না।’ –তাবারানি, জামে সগির
হজরত আবু উমামা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘তিন ব্যক্তি এমন রয়েছে, যাদের ফরজ ও নফল কোনো ইবাদতই আল্লাহতায়ালা কবুল করেন না। তারা হলো- পিতা-মাতার অবাধ্য ব্যক্তি, উপকার করে খোঁটা দানকারী এবং তাকদিরকে মিথ্যা প্রতিপন্নকারী। -কিতাবুস সুন্নাহ
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, চার ব্যক্তি এমন রয়েছে, যাদেরকে আল্লাহতায়ালা জান্নাত দান না করলেও তা সঙ্গত হবে। তারা হলো- মদপানে অভ্যস্ত ব্যক্তি, সুদখোর, এতিমের সম্পদ গ্রাসকারী এবং পিতা-মাতার অবাধ্য ব্যক্তি। -মুসতাদরাকে হাকেম
হজরত সাওবান (রা.) বর্ণনা করেন, ‘তিনটি বিষয় এমন- বর্তমানে যেগুলোর কোনো আমলই ফলদায়ক নয়। আর তাহলো- আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করা, পিতা-মাতার অবাধ্যতা ও জিহাদ চলাকালে যুদ্ধক্ষেত্রে পৃষ্ঠপ্রদর্শন। -তাবারানি
হজরত আবু বকর (রা.) নবী করিম (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, ‘আল্লাহতায়ালা তার ইচ্ছামাফিক অনেক গোনাহের শাস্তি কেয়ামতের দিন দেওয়ার জন্য রেখে দেবেন। কিন্তু পিতা-মাতার অবাধ্যতা এমনই একটি গোনাহ, যার শাস্তি আল্লাহতায়ালা দুনিয়াতেই দিয়ে দেন।
হজরত ইবনে আবু আওফা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত আলকামার মৃত্যু সম্পর্কে একটি দীর্ঘ হাদিস রয়েছে। মৃত্যুকালে সে কোনোভাবেই মুখে তাওহিদের কালেমা উচ্চারণ করতে পারছিল না। এ সাহাবির প্রতি তার মা অসন্তুষ্ট ছিল। অতঃপর হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুপারিশে তার মা তাকে ক্ষমা করে দেন এবং তখনই তার মুখে তাওহিদের কালেমা নিঃসৃত হয়।
হজরত ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেন, ‘তিন ব্যক্তি এমন- যাদের প্রতি কেয়ামতের দিন আল্লাহতায়ালা অপ্রসন্ন থাকবেন। তারা হলো- পিতা-মাতার অবাধ্য ব্যক্তি, মদপানে অভ্যস্ত ব্যক্তি ও উপকার করে খোঁটা দানকারী। অতঃপর বললেন, ৩ ব্যক্তি বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না। তারা হলো- পিতা-মাতার অবাধ্য ব্যক্তি, দাইয়ুস অর্থাৎ ওই ব্যক্তি যার স্ত্রী ব্যভিচারিণী অথচ সে তাতে বাধা দান করেনি বা তার প্রতিকার করেনি এবং পুরুষের বেশ ধারণকারী নারী।’ -ইবনে হিব্বান
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘পিতা-মাতার সন্তুষ্টির ওপরই আল্লাহর সন্তুষ্টি আর পিতা-মাতার অসন্তষ্টির ওপরই আল্লাহর সন্তুষ্টি নির্ভর করছে।’
হজরত মোয়াবিয়া ইবনে জাহাম সুহামি নবী করিম (সা.)-এর সঙ্গে জিহাদে যাওয়ার অনুমতি চাইলে তিনি তাকে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে বললেন, ‘যাও, তোমার আম্মার সেবা করো। কিন্তু তিনি জিহাদে যাওয়ার জন্য বার বার অনুরোধ জানাতে থাকলে তিনি বললেন, হায় আফসোস! তোমার মার পা ধরে থাকো। ওখানেই তোমার জান্নাত।’ -ইবনে মাজাহ
হাদিসে আরও বলা হয়েছে, পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তানের প্রতি আল্লাহতায়ালা কিয়ামতের দিন তাকাবেন না। আরেক হাদিসে বলা হয়েছে, পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান জান্নাতে প্রবেশ করবে না। পিতা-মাতার অবাধ্যতার বিভিন্ন রূপ হতে পারে। যেমন-
ক. পিতা-মাতার ওপর নিজেকে বড় মনে করা। অর্থাৎ সম্পদ, শিক্ষা-দীক্ষা, সম্মান-প্রতিপত্তি ইত্যাদি বিষয়ে পিতা-মাতার চেয়ে নিজেকে বড় মনে করা।
খ. পিতা-মাতাকে সহায়-সম্বলহীন এবং নিঃস্ব অবস্থায় ফেলে রাখা এবং যার কারণে তারা মানুষের দ্বারে দ্বারে হাত পাততে বাধ্য হয়।
গ. বন্ধু-বান্ধব, স্ত্রী-সন্তান বা অন্য কাউকে, এমনকি নিজের প্রয়োজনকেও পিতা-মাতার ওপর অগ্রাধিকার দেওয়া তাদের অবাধ্যতার অর্ন্তভুক্ত।
ঘ. পিতা-মাতাকে শুধু নাম ধরে বা এমন শব্দ প্রয়োগে ডাকা যা তাদের অসম্মান ও মর্যাদাহানীর ইঙ্গিত দেয়।
ঙ. পিতা-মাতার সঙ্গে চোখ রাঙিয়ে ধমকের সুরে কথা বলা।
চ. তাদের সেবা-শুশ্রূষা না করা এবং শারিরীক বা মানসিক বিষয়ের দিকে খেয়ালা না রাখা। বিশেষ করে বৃদ্ধ বয়সে রোগ-ব্যাধিতে তাদের প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করা।