আবারও আলোচনায় পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালি। দেশটিতে সামরিক বাহিনীর একটি অংশের হাতে আটক হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট ইবরাহিম বোউবাকার কেইতা পদত্যাগ করেছেন। এ কারণে গণমাধ্যমে মালি। মূলতঃ যুদ্ধ, বিদ্রোহ, দাঙ্গা, সন্ত্রাসী হামলা ও অভিযান ছাড়া মালি সাম্প্রদিক সময়ে আলোচনায় আসেনি। দরিদ্র দেশ বলে কথা। তবে, মালি এখন দরিদ্র দেশ হলেও একসময় ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ও স্বচ্ছল দেশ। সেই ইতিহাস অনেকটা গল্পের মতো।
১৪ শতাব্দীতে ইউরোপে যখন দুর্ভিক্ষ আর খাদ্যাভাবে লাখ লাখ মানুষ মারা যায়, তখন খাবারের অভাব কী মালির লোকজন তা জানত না। আর ইতিহাসে গত এক হাজার বছরের মধ্যে সবচেয়ে ধনবান যে ব্যক্তিটির নাম রয়েছে, তিনি মালির মুসলিম রাজা ‘মানসা মুসা।’ মানসা মুসার ইতিহাস পরে বলছি, এর আগে মালির এখনকার অবস্থার সূচনা নিয়ে একটু আলোচনা করে নেই।
উপনিবেশ এর জন্য দায়ী। উপনিবেশ কী? যখন কোনো দেশ অপর একটি দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্ষমতা করায়ত্ত করে অর্থাৎ তার অর্থনৈতিক ক্ষমতা দখল করে, সেই আক্রান্ত দেশকে উপনিবেশ বলে। একদা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম উপনিবেশিক শক্তি ছিলো ফ্রান্স। ১৯০৪ সালে ফরাসি সেনারা মালি দখল করে নেয়।
পরে ১৯৬০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ফরাসি উপনিবেশের কবল থেকে স্বাধীনতা লাভ করে মালি। এরপরও ফ্রান্স মালির আর্থ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভাব বজায় রাখে। বিশেষ করে ইউরেনিয়াম ও স্বর্ণসহ অন্যান্য খনিজ সম্পদের ভাণ্ডারের সবই যায় ফ্রান্সের গোলায়। ‘স্বাধীনতা’ লাভের পরও নানা চুক্তির আওতায় মোট জাতীয় সম্পদের ৮৫ ভাগ যায় প্যারিসে আর ১৫ ভাগ থাকে মালির জনগণের জন্য। যদি কেউ বিদ্রোহ করে? তবে মালির টাকায় পোষা ফ্রান্সের সেনাবাহিনী চলে আসে ‘কথিত সন্ত্রাসবাদ দমন’ করতে! এই হলো- রাজনীতি আর উপনিবেশবাদের ফলাফল। আর মালির দরিদ্র হওয়ার কারণ।
এবার মানসা মুসার কথা বলা যাক। একাধিক সূত্রমতে তিনি ছিলেন হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয় মোয়াজ্জিন কৃষ্ণকায় সাহাবি হজরত বিলাল রাযিয়াল্লাহু আনহুর বংশধর। মালির রাজা আবু বকর আমেরিকা আবিষ্কারের মিশনে গিয়ে আর ফিরে না আসলে সিংহাসনে বসেন তার ভাই মানসা মুসা।
স্থানীয় ভাষায় ‘মানসা’ অর্থ আমির বা রাজা। মালির অন্য রাজাদের থেকে মানসা মুসা একটু আলাদা। ইসলামের প্রতি তার ভালোবাসা ও একনিষ্ঠতা তাকে এই বৈশিষ্ট্য দিয়েছে। তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতে আদায় করতেন। ভালো আরবি জানতেন ও নিয়মিত কোরআন তেলাওয়াত করতেন। আল্লাহর দেওয়া তার বিশাল ধনভাণ্ডার তিনি খরচ করেছিলেন আফ্রিকার বুকে ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য। দান-খয়রাতের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন কিংবদন্তী। তিনি পশ্চিম আফ্রিকায় প্রচুর মাসজিদ নির্মাণ করেন, এসব মসজিদের অনেকগুলো ৭০০ বছর পরও টিকে আছে। দ্বীনি ইলম শিক্ষার জন্য সাম্রাজ্যজুড়ে অসংখ্য মাদরাসা তার পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠিত হয়।
টিম্বাকতুর সাংকোরে মাদরাসাকে তিনি পুরোপুরি বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করেন। সেখানে প্রায় ২৫ হাজার শিক্ষার্থীর পড়ালেখার সুব্যবস্থা ছিল। বিশ্বের নামিদামি শিক্ষকেরা সেখানে ক্লাস নিতেন। সেখানে ছিল আলেকজান্দ্রিয়ার পর বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লাইব্রেরি।
১৩২৪ সালে তিনি হজযাত্রা করেন বিশাল বহর নিয়ে। সে সময় ইউরোপ প্রথমবারের মতো মানচিত্রে মালির নাম যোগ করে। বলা হয়, ১২ হাজার দাসসহ প্রায় ৬০ হাজার মানুষের কাফেলা নিয়ে হজযাত্রা করেন তিনি। যাত্রাপথে গরীব মুসলমানদের প্রচুর স্বর্ণ দান-খয়রাতের পাশাপাশি অনেক মসজিদ নির্মাণ করেন। ডানে-বামে তার স্বর্ণ বিতরণের ফলে মিসর ও হেজাযে স্বর্ণ মুদ্রার মান পড়ে যায়। হজ থেকে ফেরার সময় মিসর পৌঁছে দেখেন, বেশি খরচ করার কারণে দেশে ফেরা মুশকিল। শেষ পর্যন্ত মিসর থেকে অর্থ ধার করে তাকে দেশে ফিরতে হয়।
মালির রাজধানীর নাম বামাকো। ১৯৬০ সালে মালি স্বাধীনতা লাভ করে। ১২ লাখ ৪০ হাজার ১৯২ বর্গকিলোমিটার দেশের জনসংখ্যা প্রায় দুই কোটি। মালির অধিকাংশ মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী।
১৯৬০ সালে স্বাধীন হলেও দেশটি স্বৈরশাসনের কবলে পড়ে ফ্রান্সের ইন্ধনে। ১৯৯১ সালে মালি স্বৈরশাসন থেকে মুক্ত হয় সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। ১৯৯২ সালে অনুষ্ঠিত হয় গণতান্ত্রিক নির্বাচন। ২০১১ সালে থেকে দেশটিতে জাতিগত বিদ্রোহ দেখা দেয়। পরে নানা ঘটনা পরিক্রমা শেষে ২০১২ সালের ২২ মার্চ সামরিক শাসন জারি করা হয়। পরিস্থিতি তাতেও শান্ত হয়নি। বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির দরুণ মালি সরকার ফ্রান্স সেনাবাহিনীর সাহায্য চায়, জাতিসংঘ হস্তক্ষেপ করে। বাংলাদেশ থেকেও ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে মালিতে প্রথম শান্তিরক্ষী পাঠানো হয়।
২০১৩ সালের জুলাই মাসে রাষ্ট্রপতি ও নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পদত্যাগী প্রেসিডেন্ট ইবরাহিম কেইতা নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালে তিনি দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হলে শুরু হয় বিশৃঙ্খলা। আপাতত সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে তিনিও পদত্যাগ করলেন। তবে এর সমাপ্তি কোথায় গিয়ে হবে, এই মুহূর্তে বলা মুশকিল।
মালি মুসলিম ঐতিহ্যের দেশ। এর প্রতিটা শহরেই রয়েছে নান্দনিক মসজিদ। সব মসজিদেরই রয়েছে ঐতিহাসিক গৌরবময় অধ্যায়। যেমন মালির ডিজেনি শহরে ১২০০ থেকে ১৩০০ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে তৈরি হয়েছিল বড় মসজিদ নামে পরিচিত মাটির মসজিদটি। এটি আফ্রিকার অন্যতম নির্দশন। ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় থাকা এই শহরের মসজিদগুলো বেশ জনপ্রিয়। ইট-কাদার তৈরি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মসজিদ এটি।
মালিতে প্রতি চারজনে তিনজন বাস করেন দরিদ্রসীমার নীচে। গড়ে প্রতি চারজনে তিনজন অশিক্ষিত। আয়তনে বাংলাদেশের আটগুণ হলেও মালিতে বিশ্ববিদ্যালয় মাত্র একটি। কয়েকশ বছর আগে মুসলিম শাসনের সময় ছিল কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়।
অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, সবচেয়ে ধনী থেকে সবচেয়ে দরিদ্র এলাকায় পরিণত হলো কেন? উত্তরটা আগেই দিয়েছি। ফরাসি সাম্রাজ্যবাদীরা এ জন্য দায়ী।
তবে আফ্রিকায় ইসলামের প্রচার-প্রসারে মালির গুরত্ব ও অবদান অপরিসীম। এখন দরিদ্র হলেও এর ইতিহাস হারিয়ে যায়নি। পশ্চিম আফ্রিকার মুসলিমদের জীবনে এই ইতিহাস এখনও জিইয়ে আছে এবং বিশ্বে মালি যে ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছে তা আজও অব্যাহত।