‘১. কসম যুগের, ২. নিশ্চয় মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত, ৩. কিন্তু তারা নয়, যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে তাকিদ করে সত্যের এবং তাকিদ করে সবরের।’ –সূরা আসরের অনুবাদ
হিজরতের আগে মক্কায় নাজিল হওয়া সূরা আসরের আয়াত সংখ্যা তিন। এটি পবিত্র কোরআনের ১০৩ নম্বর সূরা। মুফাসসিরদের মতে ছোট হলেও এ সূরায় রয়েছে কোরআনের সমস্ত লক্ষ্য ও জ্ঞানের সংক্ষিপ্তসার। অনেকটা বিন্দুর মাঝে সিন্ধুর পূর্ণতা।
আসর শব্দের অর্থ সময়, কাল বা যুগ কিংবা মানবজাতির ইতিহাস ও যুগের একটি অংশ। অবশ্য অনেকেই মনে করেন, এখানে আসর বলতে গোটা কাল, প্রবাহ ও মানবজাতির ইতিহাসকে বোঝানো হয়েছে। যা মানুষের চেতনা আর বিবেক জাগানো বহু শিক্ষণীয় ও লোমহর্ষক ঘটনা এবং উত্থান-পতন কিংবা চড়াই-উৎরাইয়ের সাক্ষী।
আবার অনেক মুফাসসিরের মতে, যুগ বলতে এখানে কেবল নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাবের যুগকে বোঝানো হয়েছে। যে যুগে ঘটেছিল মানবজাতির কল্যাণের জন্য ইসলামের সূর্যোদয়, ওই যুগ হলো- মিথ্যার ওপর সত্যের বিজয়ের যুগ।
এ সূরার শুরুতে আল্লাহতায়ালা শপথ নিয়েছেন সময় তথা কালের। যাতে মানুষ এই মহান নিয়ামতের অশেষ গুরুত্ব উপলব্ধি করে এর যথাযথ ব্যবহারের প্রতি সচেতন হয়। কারণ, সময় মহান ও কল্যাণকর এক সৃষ্টি।
সূরা আসরের দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলছেন, নিঃসন্দেহে সব মানুষই ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। অর্থাৎ মানুষের সবচেয়ে বড় পুঁজি জীবন, যার আয়ু বরফের মতো ক্রমেই গলে যাচ্ছে। স্রোতের মতো দ্রুত বয়ে যাচ্ছে মানুষের জীবনের মুহূর্ত, ঘণ্টা, দিন-রাত, সপ্তাহ, মাস আর বছরগুলো। যতোই দিন যায়, মানুষের যৌবনের অমিত তেজ ও শক্তি ক্ষয়িষ্ণু হতে থাকে। যন্ত্রের মতো আমাদের হৃদপিণ্ড একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সক্রিয় থাকে। নির্দিষ্ট সময় শেষ হলে, নিজ থেকেই থেমে যায় হৃদপিণ্ডের স্পন্দন। এমনকি হৃদপিণ্ড অকেজো হয়ে যাওয়ার জন্য কোনো কারণ কিংবা অসুখেরও দরকার হয় না। মানুষের সব শক্তি, ক্ষমতা আর প্রতিভার বিষয়টিও এই রকম।
ইসলামি স্কলারদের মতে, মানুষের পার্থিব জীবন ব্যবসার কেন্দ্র মাত্র। তাদের মতে, দুনিয়া হচ্ছে বাজারের মতো। যেখানে একদল লোক লাভ করে ও অন্য দলটি ক্ষতির শিকার হয়। উদ্ধত্য ও অশান্ত প্রবৃত্তি মানুষকে প্রতিনিয়ত ক্ষতি ও পতনের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়। এ অবস্থা থেকে কেবল তারা বেঁচে থাকে, যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে যায়, একে-অপরকে সত্যের, ধৈর্যধারণের আর প্রতিরোধের উপদেশ দেয়।
মানুষের জীবনের দুনিয়ার অংশটুকু পরীক্ষা মাত্র। এ পরীক্ষার অনিবার্য পরিণতি হলো- চিরন্তন সৌভাগ্য কিংবা চিরন্তন দুর্ভাগ্য তথা বেহেশত অথবা দোজখ।
জ্ঞানীদের মতে, মানুষের জীবনের এই পরিণতির জন্য সে নিজেই দায়ী। মানুষের আয়ু হলো তার পুঁজি। কেউ যদি এই দুনিয়ার জীবনে বিশ্বাস ও কাজের মাধ্যমে সত্যের অনুসরণ করে তাহলে সে হয় সফল ব্যবসায়ী, তার আয় হয় বরকতময়। ফলে তার ভবিষ্যৎ হয় নিরাপদ। কিন্তু যে মিথ্যার অনুসারী ও আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস আর সৎ কাজকে এড়িয়ে চলে সে হয় ব্যর্থ ব্যবসায়ী। তার পুঁজি-বিনিয়োগে কোনো লাভ তো আসেই না বরং এই বিনিয়োগ হয় তার সর্বনাশের মাধ্যম। পরকালের কল্যাণ থেকে সে বঞ্চিত হয়। সূরা আসর মানুষকে এ বিষয়েই সচেতন হতে বলে।
সূরা আসরে মানুষকে একটি কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে, যা পালন করলে মানুষ ক্ষতিমুক্ত হবে। ওই কর্মসূচির শুরুতে ঈমান বা বিশ্বাসের কথা বলা হয়েছে। বস্তুত ঈমান হলো, মানুষের সব তৎপরতার ভিত্তি। মানুষের কাজেই প্রকাশ পায় তার বিশ্বাস। এ জন্যই সব নবী ও রাসূল জনগণের বিশ্বাসের ভিত্তিগুলোর সংস্কার করাকে তাদের প্রথম কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এ জন্য নবী-রাসূলরা নানা ধরনের জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তার পরও তারা ছিলেন, তাদের লক্ষে অবিচল।
সূরা আসরে সৎকাজকে মানুষের মুক্তির নিশ্চয়তা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সৎকাজ বলতে কেবল ইবাদত-বন্দেগি, দান-খয়রাত, জিহাদ ও জ্ঞান অর্জন করাকে বোঝায় না। সব ধরনের ভালো কাজই সৎকাজ। যেসব কাজ মানুষের আত্মিক পূর্ণতা, নৈতিক উন্নয়ন ও সমাজের উন্নয়নে সহায়ক; তার সবই হলো সৎকাজ।
ঈমান ও সৎকাজ কখনও গতিশীল থাকে না যদি না এর ধারক ও বাহকদের সবাই আল্লাহর পথে, সত্য ও ধর্মের জ্ঞানের পথে, প্রতিরোধ ও ধৈর্যের পথে আহ্বান জানানোর সর্বজনীন আন্দোলনে শরিক না হয়। পরস্পরকে সত্যের ও ধৈর্যের উপদেশ দেওয়া এই সর্বজনীন আন্দোলনের একটি অংশ। যা মানুষকে ক্ষতি ও বিচ্যুতি থেকে রক্ষা করে এবং মানুষকে মনুষ্যত্বের শিখরে ও পূর্ণতায় পৌঁছে দেয়।