মানুষ শব্দের দ্বিতীয় ক্রিয়াপদ ‘মানুষ হওয়া।’ মানুষ হওয়া মানে সত্য বলা, কারও ক্ষতি না করা, প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা, বিপদে-আপদে অন্যকে সাহায্য করা ও সদাচরণ ইত্যাদি। এমন গুণসম্পন্ন মানুষ সমাজে বিরল নয়, আবার সুলভও নয়। বস্তুত মানুষ হিসেবে ভুল-ত্রুটি নিয়েই আমাদের জীবন, ভালো-মন্দ মিলিয়েই আমাদের বেঁচে থাকা। তার পরও এই সমাজে রয়েছে মানুষের নানা রূপ।
আসলে ভালো-মন্দের ধারণা অনেকটা আপেক্ষিক। আমার কাছে যা ভালো, অন্যজনের কাছে তা ভালো নাও হতে পারে। আমার কাছে যা মন্দ তা আরেকজনের কাছে মন্দ নাও হতে পারে। তারপরও নৈতিকতার সার্বজনীন গ্রহণযোগ্য একটা সংজ্ঞা আছে।
ওই সংজ্ঞার আলোকে বলা যায়, ‘নিজের বিবেককে কাজে লাগিয়ে যে ব্যক্তি তার নৈতিক দায়িত্বগুলো যথাযথভাবে পালন করেন, চরিত্রের ভালো উপাদানগুলো গ্রহণ ও মন্দ উপাদানগুলো বর্জন করেন তিনিই প্রকৃত অর্থে ভালো মানুষ।’
আমরা সবাই ভালো মানুষ হতে চাই, এমনকি সমাজের চিহ্নিত সন্ত্রাসী কিংবা দুষ্টু প্রকৃতির লোকটিও কথায় কিংবা আলাপচারিতায় ভালো মানুষের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। এভাবে সমাজের সবাই ভালো মানুষ হতে চায়। কারণ, ভালো মানুষের সুফল সমাজের সবাই ভোগ করেন।
এখন প্রশ্ন হলো, স্বপ্নের সেই ভালো মানুষ কোথায়? তারা হলেন, আপনি, আমি, সে, তারা। মনে রাখতে হবে, ভালো মানুষ আকাশ থেকে আসবে না। এই সমাজ থেকে ভালো মানুষের দেখা মিলবে। তাহলে ভালো মানুষ হওয়ার জন্য কী কী প্রয়োজন? তার জন্য কোনো টাকার দরকার হয় না। আমার-আপনার মনের সুপ্ত ইচ্ছাশক্তি, দৃঢ়চেতা মনোবলই পারে ভালো মানুষ বানাতে।
কোরআন-সুন্নাহর আলোকে ভালো মানুষ তিনি, যিনি কোরআন-হাদিসে ঘোষিত আল্লাহ প্রদত্ত আদেশাবলি পালন এবং নিষেধাবলিকে পরিত্যাগ করে একনিষ্ঠভাবে নৈতিক দায়-দায়িত্বগুলো পরিপূর্ণভাবে পালন করেন। ভালো মানুষ সব ধরনের গোনাহ থেকে মুক্ত থাকেন।
গোনাহ দুই প্রকার- ১. কবিরা, ২. সগিরা। কোরআন-হাদিসে কবিরা গোনাহর সঠিক সংখ্যা উল্লেখ নেই। তবে কোরআন-হাদিসের আলোকে উল্লেখযোগ্য কবিরা গোনাহ হলো- শিরক, হত্যা, জাদু, নামাজ ত্যাগ, জাকাত অনাদায়, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হজ না করা, আত্মহত্যা, পিতা-মাতার অবাধ্যতা, ব্যভিচার, সমকামিতা, সুদের লেনদেন, এতিমের সম্পদ আত্মসাৎ, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা, অহংকার, মিথ্যা সাক্ষ্যদান, মদপান, জুয়া, সতী নারীর বিরুদ্ধে অপবাদ, চুরি, ডাকাতি, আল্লাহ ও তার রাসূলের ওপর মিথ্যারোপ, মিথ্যা শপথ, জুলুম-নির্যাতন, মিথ্যা কথা, ঘুষ খাওয়া, অশ্লীলতা, খিয়ানত করা, চোগলখুরী করা, গালি দেওয়া, ওয়াদা ভঙ্গ করা, অহংকার, প্রতিবেশীকে কষ্ট দেওয়া, ওজনে কম দেওয়া, ধোঁকাবাজি, কৃপণতা, বিচারে দুর্নীতি করা ইত্যাদি। একজন ভালো মানুষ কবিরা ও সগিরা গোনাহ থেকে মুক্ত হবেন।
ভালো মানুষের পরিচয় দিতে গিয়ে বিভিন্ন হাদিসে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য এসেছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিম (সা.) কে প্রশ্ন করা হলো, ভালো মানুষ কে? নবী করিম (সা.) বলেন, ভালো মানুষ তিনিই যে আল্লাহকে বেশি ভয় করে। -সহিহ বোখারি: ৪৬৮৯
অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি সেই, যার চরিত্র সবচেয়ে বেশি সুন্দর। -সহিহ বোখারি: ৩৫৫৯
আরেক হাদিসে বলা হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ওই ব্যক্তি যে নিজ পাওনাদারের পাওনা উত্তমভাবে পরিশোধ করে। -সহিহ বোখারি: ২৩০৫
হাদিসে আরও ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট আরজ করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল! সর্বোত্তম মানুষ কে? তিনি বললেন, ওই ব্যক্তি, যার অন্তর পাপমুক্ত, পরিষ্কার, কারও প্রতি কোনো আক্রোশ ও বিদ্বেষ নেই এবং যে সত্যবাদী হয়। -ইবনে মাজাহ: ৪২১৬
বর্ণিত হাদিসগুলোতে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) স্থান, কাল, অবস্থা ও প্রেক্ষাপটের আলোকে ভালো মানুষের পরিচয় তুলে ধরেছেন পৃথক পৃথকভাবে।
তবে এটা স্পষ্ট যে, ভালো হওয়া অসাধ্য কিংবা কঠিন কোনো কাজ নয়। ভালো হতে প্রয়োজন- সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার সঙ্গে ভালো গুণগুলো নিজের ভেতরে ধারণ করা। সেই সঙ্গে অসৎ কাজ ও মন্দ স্বভাব থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা।
জীবন চলার পথে বিচিত্র চরিত্রের বহু মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলতে হয়। এই মানুষগুলোর মধ্যে পরিবারের সদস্য, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশী, সহকর্মীর সংখ্যাই বেশি। তাদের ঘিরেই আপনার-আমার জগত। তাদের সঙ্গেই যদি সুসম্পর্ক বজায় রাখতে না পারেন, তাহলে আপনার জীবনের মূল্য কী রইল? আপনার পরিবারের লোকজন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও সহকর্মীরা আপনাকে মন্দ বলে, তাদের সঙ্গে আপনি মিলে চলতে পারেন না। তাদের ক্ষতি করেন, তাদের সঙ্গে মন্দ আচরণ করেন। তাহলে আপনি কার কাছে ভালো, নিরবে একটু চিন্তা করে দেখবেন!
পিতা-মাতার সব সন্তান যেমন সমান হয় না, তেমনি আপনার-আমার আপনজনরাও এক একজন এক এক স্বভাব-চরিত্রের। কেউ বদমেজাজী, কেউ নরম স্বভাবের, কেউ বেশি কথা বলে, কেউ কম কথা বলে, কেউ স্বার্থপর, কেউ উদার প্রকৃতির, কেউ কৃপণ, কেউ দানশীল, কেউ অহংকারী, কেউ বিনয়ী। এই বিচিত্র স্বভাবের মানুষগুলোর সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে চলা সহজ ব্যাপার নয়। এ জন্য প্রয়োজন, সবার আগে নিজেকে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। ভালো গুণাবলির গুণে নিজেকে গুণান্বিত করা এবং বর্জনীয় ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখাই হলো- ভালো মানুষ হওয়ায় মূল উপায়।
ভালো মানুষ হতে হলে আন্তরিকতা, নিষ্ঠা, সদিচ্ছা থাকাটা আবশ্যকীয়। এ ছাড়া সত্য কথা বলা, পরোপকার করা, ক্ষমা করা, হিংসা-বিদ্বেষ-লোভ ত্যাগ করা, অন্যের হকসমূহ আদায় করা, ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা, খারাপ অভ্যাস পরিত্যাগ করা, ভালো কাজ করা, ইতিবাচক মনোভাব থাকা, নিজের ভুলের স্বীকৃতি দেওয়াসহ মহান সৃষ্টিকর্তার আদেশাবলি মেনে চলা ও নিষেধাবলি পরিত্যাগ করার মাধ্যমে ভালো মানুষ হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করতে হবে।
ভালো মানুষ হতে হলে আমাদের শরীর বা দেহের ওপর বিবেকের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সরল দৃষ্টিতে ভালো মানুষ হওয়া খুবই কষ্টের। তবে ভালো মানুষ হওয়া যদিও কষ্টের কিন্তু অমানুষ হওয়া মানুষ হওয়ার চেয়ে আরও অনেক বেশি কষ্ট ও লাঞ্ছনার বিষয়। এবার সিদ্ধান্ত নিন, কোনটা আপনি গ্রহণ করবেন।