‘আমি খুবই খুশি হইছি। এই করোনার জন্যি শহরের অনেক মানুষ গ্রামে চইলে গ্যাছে, আমার কামাই-রোজগারও কইমে গেছে। সংসার চালানু মুশকিল হইয়ে গ্যাছে। সুদির ওপর টাহাতো অনেকেই দিতি চায়, কিন্তু ধরেন আমি নামাজ পড়ি, সুদির ওপর টাহা নিয়াতো সম্ভব না। এহন হুজুররা আমাগে ভ্যান দেলো, টাহা দেলো। এই ভ্যান আর টাহাটা পাইয়ে আমার বহুত উপকার হইছে। আমি নতুন কইরে আমার ব্যাবসাডা দাঁড়া করাতি পারবানি।’
বৃহস্পতিবার (১২ সেপ্টেম্বর) আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের কোভিড-১৯ এ ক্ষতিগ্রস্ত দিনমজুর ও ভাসমান ব্যবসায়ীদের ‘স্বনির্ভরতার উদ্যোগ’ প্রকল্পের আওতায় একটি করে নতুন ভ্যান ও নগদ টাকা পেয়ে এভাবেই নিজের অনুভূতির কথা ব্যক্ত করছিলেন- ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও দিনমজুর রেজাউল করিম। তিনি গোপালগঞ্জ জেলার তেঘরিয়ার বাসিন্দা।
গোপালগঞ্জের গোপীনাথপুরের আরেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জাকিবুর রহমান বলছিলেন, ‘আমি ঢাহায় ছোটখাটো ব্যবসা কইরে সংসার চালাতাম। করোনার জন্যি বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে দ্যাশে আইসে বেকার বইসেছিলাম। এহন হুজুরের দিয়া এই ভ্যান আর টাহা দিয়ে আমি সবজি বা অন্যকিছুর ব্যবসা করতি পারবানি। দ্যাশে কত জাগা টাহা চাইছি। কেউ সুদ ছাড়া টাহা দিতি চায় না। হুজুর আমাগে এই ভ্যান আর টাহা আল্লার অস্তে দিয়ে দেছে। কোনো কিস্তি বা সুদ দিয়া লাগবেনানে কইছে। আমি খুব খুশি হইছি।’
বৃহস্পতিবার নারায়ণগঞ্জের একটি স্কুল মাঠে ভ্যান ও নগদ পাঁচ হাজার টাকা হস্তান্তর করা হয় করোনার প্রাদুর্ভাবে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া দেশের বিভিন্ন এলাকার পঞ্চাশ জন ক্ষুদ্র ও ভাসমান ব্যবসায়ীদের মাঝে। তারা লকডাউনের কয়েক মাস বসে বসে খেয়ে পুঁজি খুইয়েছেন। এই সব লোকদের আত্মনির্ভরশীল করার লক্ষ্যে ভ্যান ও ব্যবসার পুঁজি হিসেবে নগদ টাকা বিতরণ করেছে আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশন।
ভ্যানের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য আবেদনকারীর মহল্লার মসজিদের ইমাম ও আরেকজন দায়িত্বশীলকে জামিনদারের দায়িত্বগ্রহণের শর্ত আরোপ করা হয়েছে। আরও শর্ত দেওয়া হয়েছে, এক বছর পর্যন্ত কোনো আবেদনকারী ভ্যান বিক্রয় বা হস্তান্তর করতে পারবেন না। তবে আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশন বলেছে, তারা এই ভ্যান ও পুঁজি দিয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসা করে যদি স্বাবলম্বী হতে পারে; তাহলে তাদেরকে আরও সহযোগিতা করা হবে।
আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশন একটি অলাভজনক, অরাজনৈতিক এবং পূর্ণত মানবকল্যাণে নিবেদিত সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। এই ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান শায়খ আহমাদুল্লাহর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে ভ্যান গ্রহীতাদের প্রশিক্ষণ দেন সরোবরের শরীফ আবু হায়ত অপু। উপস্থিত ছিলেন জনপ্রিয় আলোচক শায়খ আবদুল হাই মুহাম্মাদ সাইফুল্লাহ ও বিশিষ্ট টিভি উপস্থাপক শায়খ মাহমুদুল হাসান, মাওলানা শরীফ আনিসুর রহমান প্রমুখ।
এর আগে আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশন চার হাজার করোনাগ্রস্ত পরিবারকে এক মাসের খাদ্যদ্রব্য ও ১-৫ হাজার টাকা পর্যন্ত নগদ অর্থ সহায়তা এবং লকডাউনের সময় বেকার হয়ে যাওয়া এক হাজার উবার রাইডারকে ১০০০ টাকা করে প্রদান করেছে।
আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশন শিক্ষা, সেবা ও দাওয়াহ- তিন বিভাগে কাজ করছে। সারা দেশের ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে অসচ্ছল, দরিদ্র নারী-পুরুষকে স্বনির্ভর করতে কাজ করে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশন প্রতি ঈদে অসহায় শিশুদের নতুন জামাকাপড় দেওয়ার পাশাপাশি বন্যা, নদীভাঙন বা প্রাকৃতিক নানা দুর্যোগ-দুর্ঘটনায় ত্রাণ বিতরণ করে থাকে। গত কোরবানির ঈদে দরিদ্র অঞ্চলগুলোতে অর্ধকোটি টাকার বেশি কোরবানির পশুর গোশত বিতরণ করেছে তারা। অনাথ ও দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদানসহ মাদরাসাতুস সুন্নাহ নামে স্বতন্ত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলেছে আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশন। আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের এমন বহুমুখী সেবার মাধ্যমে জনগণ উপকৃত হচ্ছেন।
শায়খ আহমাদুল্লাহ বাংলাদেশের আলোচিত একজন ইসলামি ব্যক্তিত্ব। তার উদার ও মানবিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ড তরুণ প্রজন্মকে আশার আলো দেখাচ্ছে। এ ছাড়া টেলিভিশন, ফেসবুক ও ইউটিউবে তার তথ্যনির্ভর ও গবেষণাধর্মী আলোচনা বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। তিনি ইসলামের আলোকে সমসাময়িক নানা সমস্যার বিশ্লেষণ করে থাকেন। ইতিবাচক ও উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে শুদ্ধ ভাষায় উপস্থাপিত তার এসব আলোচনায় অসংখ্য শ্রোতা ও দর্শক উপকৃত হচ্ছেন।
১৫ ডিসেম্বর ১৯৮১ লক্ষ্মীপুরে জন্ম শায়খ আহমাদুল্লাহর। কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড (বেফাক) থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে দাওরায়ে হাদিস শেষ করে খুলনা দারুল উলুম থেকে ইফতা সম্পন্ন মুফতি সনদ লাভ করেন। মিরপুরের দারুর রাশাদ মাদরাসায় শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে তার কর্মজীবনের শুরু। ২০০৩ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত সেখানে কর্মরত ছিলেন। এক বছর মিরপুরের আরজাবাদ মাদরাসায়ও শিক্ষকতা করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি ২০০৪ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ইমাম ও খতিবের দায়িত্ব পালন করেন মিরপুরের বায়তুল ফালাহ জামে মসজিদে। ২০০৯ সালে সৌদি আরবের পশ্চিম দাম্মাম ইসলামিক দাওয়াহ সেন্টারে যোগ দেন দায়ি ও অনুবাদক হিসেবে। সেখানে দীর্ঘ ৯ বছর কাজ করেন। তিনি জাপান, ভারত, আরব আমিরাত ও সৌদি আরবের একাধিক আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন।
শায়খ আহমাদুল্লাহ এ পর্যন্ত দাওয়াহ ও গবেষণা বিষয়ে শতাধিক প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন। বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যমগুলোতে তার লেখা প্রকাশিত হয় নিয়মিত। আরবি ভাষাতেও প্রকাশিত হয়েছে তার অসংখ্য প্রবন্ধ। শায়খ আহমাদুল্লাহ বর্তমানে নারায়ণগঞ্জের ভূমিপল্লী জামে মসজিদের খতিব।
২০১৮ সালের মাঝামাঝিতে যাত্রা শুরু করে আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশন। ২০১৯ সালের মে মাসে রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হয় সংস্থাটির। এর পর থেকে বিভিন্ন জেলায় ৯৯টি সাধারণ ও গভীর নলকূপ স্থাপন, উত্তরবঙ্গসহ দেশের বিভিন্ন জেলা এবং বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা নাগরিকদের মাঝে শীতবস্ত্র ও রমজান মাসে ইফতারের আয়োজন করেছে। আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে যমুনার চরে ভূমিহীনদের জন্য একটি গুচ্ছগ্রাম প্রকল্প বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে।