মক্কা মোকাররমা (সৌদি আরব) থেকে: আয়েশা চৌধুরী (৪০)। দৃঢ় প্রত্যয়ী আর লড়াকু এক নারী। সৌদি আরবে বাংলাদেশের একমাত্র নারী ‘মোনাজ্জেম।’
মোনাজ্জেম হচ্ছেন, সৌদি সরকার কর্তৃক স্বীকৃত বাংলাদেশি হজ এজেন্সির মনোনীত প্রতিনিধি।
আয়েশা নিজেই হজ এজেন্সির মালিক। তার এজেন্সির নাম- ‘হজ উইথ আয়েশা।’ হজ এবং ওমরা দু’টোরই লাইসেন্স রয়েছে তার।
চলতি হজ মৌসুমেও আয়েশা হজ কাফেলার নেতৃত্ব দিচ্ছেন ইসলামের পণ্যভূমি পবিত্র নগরী মক্কা আর মদিনায়।
ধর্মীয়ভাবে রক্ষণশীল দেশ সৌদি আরবে বাংলাদেশের একমাত্র নারী মোনাজ্জেম হিসেবে হজ কাফেলা পরিচালনা করায় এক নামে সবাই চেনেন আয়েশাকে।
২০০৫ থেকে চলতি বছর পর্যন্ত প্রতিটি হজেই অংশ নিয়েছেন তিনি। মোনাজ্জেম হিসেবে আয়েশার সৌদি আরবের স্বীকৃতি পাওয়াকে অনেকে দেখেন নারীর ক্ষমতায়ন আর লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের নারীর বিজয় হিসেবে।
আয়েশা এবারও মক্কা-মদিনায় বাড়ি ভাড়া, মোয়াল্লেমদের সঙ্গে চুক্তিসহ নানা ধরণের প্রক্রিয়াগুলো নিজেই সেরেছেন। যেখানে পুরুষরাই এসব কাজে হিমশিম খায়- আপনি নারী হিসেবে কি করে সম্ভব করলেন?
‘চেষ্টা, একাগ্রতা, সততা আর লক্ষ্যে পৌঁছানোর দৃঢ়তা থাকলে সবই সম্ভব। আর আমার প্রেরণা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি একটি রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারলে নারী হিসেবে সামান্য একটি হজ এজেন্সি পরিচালনা করতে পারবো না’- স্মিত হেসে আয়েশার জবাব।
ব্রাহ্মনবাড়িয়া জেলার সদর থানার চিনাইর গ্রামের এস বি চৌধুরীর মেয়ে আয়েশা। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে তৃতীয়।
‘২০০৫ সালে প্রথম হজে আসি। দোয়া কবুল হয়- এমন সবস্থানেই আল্লাহতায়ালার কাছে মনেপ্রাণে প্রার্থনা করলাম, হে আল্লাহ! প্রতিবার আমাকে এই পূণ্যভূমিতে আসার সুযোগ করে দিন। সেই থেকে প্রতি হজেই আমি হাজির হই এখানে। এটা আল্লাহর রহমত।’
২০১৬ সালে ‘হজ উইথ আয়েশা’- নামে এজেন্সির লাইসেন্স বের করলাম। আমি কৃতজ্ঞ মন্ত্রণালয় ও হাব নেতৃবৃন্দের কাছে। তারাই আমাকে সাহস ও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। হাজীদের বাড়ি ভাড়া করতে আসবো, বিপত্তি শুরু হলো- ভিসা নিয়ে।
আমাকে ওমরা ভিসা দেওয়া হলেও ‘মোনাজ্জেম ভিসা’ কোনোভাবেই দেবে না সৌদি দূতাবাস। আমি ব্যক্তিগতভাবে দূতাবাসের কাউন্সেলরের সঙ্গে দেখা করলাম, তিনি আমাকে সাফ বলে দিলেন- কোনো নারীকে আমরা মোনাজ্জেম ভিসা দেই না।
পিছু হটলেও দমে যাওয়ার মানুষ আমি নই। মক্কার সফল হোটেল ব্যবসায়ী নোয়াখালীর আবুল কালাম মো. মাসুদ ভাই আমাকে জানালেন, এর আগে ইটালির একজন নারী মোনাজ্জেম ভিসা পেয়েছেন। সেই উদাহরণটাকে সঙ্গী করে শুরু হলো- নতুন লড়াই।
সেই চিঠিটা ভাষান্তর করে আবার গেলাম দূতাবাসে। তাদের বোঝালাম, বাংলাদেশ সরকার স্বীকৃত একজন হজ এজেন্সির মালিক হিসেবে সৌদিতে হাজীদের বাসা থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজ আমাকেই করতে হবে। এখানে কোটি টাকার লেনদেন। আমি ছাড়া সেটা করার মতো বিশ্বস্ত কেউ নেই। ইটালির নারী যদি মোনাজ্জেম ভিসা পায়, তবে বাংলাদেশের নারী হিসেবে আমি কেন তা পাবো না?
আমার কাগজপত্র দেখে দূতাবাসের কাউন্সেলর মন একটু নরম হলো এবং শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রথম নারী হিসেবে আমি পেয়ে গোলাম মোনাজ্জেম হিসেবে দুই বছরের মাল্টিপল বিজনেস ভিসা। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি আমাকে। এভাবেই নিজের সংগ্রামের ইতিকথা বলে যান আয়েশা।
দেশে সুনাম কুড়িয়েছেন সফল নারী হজ প্রশিক্ষক হিসেবে। মক্কায় এসেও থেমে নেই আয়েশা চৌধুরীর কাজ। বাংলাদেশের মা হাজীদের সেবায় স্বেচ্ছায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন তিনি। সৌদি আরবে নারী হাজীদের মা হাজী বলে সন্মান জানানো হয়। সেই নারী হাজীদের সেবায় বাংলাদেশ হজ মিশন কর্তৃক ‘নারী হজ কর্মী’ হিসেবে নিয়োগ পেলেও আয়েশা চৌধুরী কাজটি করছেন স্বেচ্ছাসেবি হিসেবে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবস্থাপনায় অনার্স মাষ্টার্স সম্পন্ন করা আয়েশা চৌধুরী বলেন, ব্যবসার সঙ্গে আল্লাহর ঘরের মেহমান হিসেবে হাজীদের সেবাটাই আমার কাছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।
সৌদি আরবে বাংলাদেশের একমাত্র নারী ‘মোনাজ্জেম’ হিসেবে স্বীকৃতি প্রাপ্তিটা আমার দেশের অর্জন। সেই অর্জনকে ধারণ করে হাজীদের দোয়া নিয়ে তাদের সেবার এগিয়ে যেতে চাই- যোগ করেন আয়েশা চৌধুরী।