তাবলিগ নিয়ে দ্বন্দ্বটা এখন আর গোপন কোনো বিষয় নয়। এটা অনেকটা প্রকাশ্যেই চলছে। দ্বন্দ্বের এক পক্ষে মাওলানা সাদ (এতায়াতপন্থী) অনুসারী অপর পক্ষে শুরাপন্থীরা (যৌথনেতৃত্ব) রয়েছেন। তাদের এ দ্বন্দ্ব ইজতেমার ময়দান বা কাকরাইল মসজিদের গণ্ডি ছাড়িয়ে জেলায় জেলায় ছড়িয়েছে। পুলিশ সদর দফতর, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অফিস এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রীকেও হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে তাবলিগের দ্বন্দ্ব নিরসনে। কিন্তু থামেনি। হাতাহাতি, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, দেন-দরবার, বিবৃতিবাজি সবই চলছে। তাবলিগ নিয়ে এমন দ্বন্দ্বে দ্বিধায় সাধারণ মানুষ। আসলে ঘটছে কী?
গণ্ডগোলের ধারাবাহিকতায় রাজধানীর কাকরাইল মসজিদে তাবলিগ জামাতের দুই পক্ষ ফের দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে। মসজিদ ও মাদরাসার কর্তৃত্ব নেওয়াকে কেন্দ্র করে শনিবার (৮ সেপ্টেম্বর) দিবাগত রাত নয়টার দিকে দ্বন্দ্ব উত্তেজনায় রূপ নেয়। মসজিদ থেকে এক পক্ষকে বের করে দেওয়ায় সময় হাতাহাতি ও ধাওয়া-পাল্টা-ধাওয়ায় বেশ কয়েকজন আহতও হন। খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। বাইরে অবস্থানকারীরা মসজিদের ভেতরে অবস্থানকারীদের ‘পাকিস্তানপন্থী’, ‘হেফাজতপন্থী’ বলে অভিহিত করে তাদের মসজিদ থেকে বের করে দেওয়ার দাবি জানায় ও স্লোগান দিতে থাকে।
কাকরাইলের ঘটনা প্রসঙ্গে রমনা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মারুফ হোসেন বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘কাকরাইল মসজিদে যা হচ্ছে, তা পুলিশের নজরে আছে। তবে পুলিশ এই বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশ কাজ করছে।’
জানা গেছে, কাকরাইল মসজিদের ভেতরে থাকা (দিল্লি) মাওলানা সাদবিরোধীদের হঠাতে ভেতরে প্রবেশ করতে চায় সাদপন্থীরা। এ সময় দু’পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। মূলত কাকরাইল মারকাজ মসজিদ ও মাদরাসার কর্তৃত্ব নিতেই এমন দ্বন্দ্ব।
তাবলিগ জামাতের মধ্যে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাজ থেকে। সেখানকার মুরুব্বি মাওলানা সাদ কান্ধলভির কিছু বিতর্কিত মন্তব্য ও নিজেকে বিশ্ব আমির ঘোষণার পর অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে নানা দেশে। বাদ যায়নি বাংলাদেশও। এরপর দৃশ্যত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে তাবলিগ জামাত। মাওলানা সাদকে তার বক্তব্য থেকে ফিরে আসতে দারুল উলুম দেওবন্দসহ বিশ্বের আলেমরা বারবার অনুরোধ করলেও তিনি তা করেননি। তবে মাওলানা সাদপন্থীদের দাবি, তিনি সঠিক পন্থায় আছেন, ভুল বক্তব্যগুলো প্রত্যাহার করেছেন কিন্তু তা আলেমরা মানছেন না।
বিগত বিশ্ব ইজতেমায় মাওলানা সাদ ঢাকায় এলেও তাকে টঙ্গির বিশ্ব ইজতেমায় যেতে দেওয়া হয়নি। বিরোধিতার মুখে কাকরাইল অবস্থান করে ভারত ফিরে যেতে বাধ্য হন। সরকারের তরফ থেকে কয়েক দফায় সমঝোতার চেষ্টায় দু’পক্ষের মাঝে সাময়িক কিছুটা বরফ গললেও কাকরাইল ও ইজতেমার মাঠের দখল নিতে মরিয়া হয়ে উঠে সাদ অনুসারীরা। দেশের আলেমরা ধর্মীয় কারণে অবস্থান নেন সাদের বিপক্ষে। খোদ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এটা নিয়ে বৈঠক করেন হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফী ও অন্য আলেমরা।
তবে ভেতরে ভেতরে দ্বন্দ্ব চলতেই থাকে। এর খানিকটা দেখা যায় চলতি বছরের ২৮ এপ্রিল। সেদিন কাকরাইলে (তাবলিগ জামাতের প্রধান কেন্দ্র, মারকাজ) সংঘর্ষে জড়ায় দুই পক্ষ। তখন থেকে দুই পক্ষের শীর্ষ একাধিক নেতাকে কাকরাইলে যেতে বারণ করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। সেই থেকে কাকরাইল আপাতত শান্ত থাকলেও বিভিন্ন জেলায় হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। কিন্তু হঠাৎ করে শনিবার দিবাগত রাত থেকে আবারও দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পরে তাবলিগের বিবদমান দুই পক্ষ। এ প্রতিবেদন লেখার সময়ও কাকরাইলে উত্তেজনা চলছিল। পুলিশ কাউকে ভেতরে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। মাওলানা সাদের অনুসারীরা বিচ্ছিন্নভাবে বাইরে টহল দিচ্ছেন। যেকোনো সময় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ঘটতে পারে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
তাবলিগ জামাতের অনুসারীদের বরাবরই শান্তিপ্রিয় বলে অভিহিত করা হতো। নেতৃত্বের দ্বন্দ্বও তাদের মাঝে ছিল না। আলেমদের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা ছিল। কিন্তু হাল সময়ে এর কিছুই আর বাকী নেই। ভারতের মাওলানা সাদের বাড়াবাড়ি ও ভুল মতবাদকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে তার অনুসারী গুটিকতক ব্যক্তির হঠকারিতা ও ভ্রান্ত মতাদর্শের ফলে তাবলিগ এখন হুমকির মুখে। তাবলিগকে কেন্দ্র করে দেশের সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষ ও আলেমসমাজকে মুখোমুখি দাঁড় করানো হচ্ছে।
এমতাবস্থায় তাবলিগ জামাতকে তার সঠিক পথের ওপর টিকিয়ে রাখার জন্য আলেমরা যেকোনো পদক্ষেপ নেবেন বলে জানান মাওলানা মুহাম্মদ মামুনুল হকসহ একাধিক শীর্ষ আলেম। তারা বার্তা২৪.কমকে বলেন, এতায়াতের (সাদের অনুসরণ) নামে আলেমসমাজ ও তাবলিগ জামাতের মধ্যে দূরত্ব ও বিরোধ সৃষ্টির ষড়যন্ত্র সফল হবে না। সারা বিশ্বের তাবলিগ সংশ্লিষ্ট মুরুব্বি, আরব-আফ্রিকাসহ ইউরোপ-আমেরিকার সব তাবলিগি মারকাজ শূরার ভিত্তিতে তাবলিগ পরিচালনার পক্ষে। কিন্তু মাওলানা সাদ ব্যক্তিগতভাবে একক সিদ্ধান্তে তাবলিগ জামাত পরিচালনা করতে চাচ্ছেন। এটা মেনে নেওয়া হবে না। তার নিজস্ব চিন্তাধারা ও তাবলিগের ঐতিহ্যবিরোধী।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাওলানা সাদ সাহেবের ভ্রান্ত মতাদর্শ প্রকাশের পর দিল্লি নিজামুদ্দিনের অনেক মুরুব্বি তাকে ত্যাগ করে মারকাজ থেকে চলে গেছেন। সাদ সাহেবকে বিশ্বের সকল দায়িত্বশীল সংশোধন ও নীতির ওপর ফিরে আসার আহ্বান জানাচ্ছেন। কিন্তু তিনি তাদের কথা শুনেননি। উল্টো বাংলাদেশে তাবলিগের দুই-একজন লোক মাওলানা সাদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার চ্যালেঞ্জ দিয়ে মাঠে নেমেছেন। তারা বাংলাদেশের আলেম সমাজের সঙ্গে তাবলিগ জামাতের দূরত্ব সৃষ্টি ও মসজিদে মসজিদে পাড়ায়-মহল্লায় বিরোধ ও আলেম বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন। কাকরাইলের শূরা ও আলেমদের সঙ্গে রীতিমতো দুর্ব্যবহার করছেন। কাকরাইলের উত্তেজনা এরই ফল।
আমরা মনে করি, তাবলিগের একটা ঐতিহ্য আছে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে যে পদ্ধতিতে তাবলিগ পরিচালিত হচ্ছে, এখনও সেভাবে চলা উচিত। এখানে নিজেদের জেদ বহাল রাখার চেষ্টা করা হবে ভুল। এর ফলে বিশৃঙ্খলা ও দ্বন্দ্ব আরও বাড়বে। শুধু তাই নয়, তাবলিগ জামাতের সঙ্গে আলেম সমাজের সুসম্পর্কেরও মারাত্মক ফাটল ধরবে। সাধারণ মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেবে দাওয়াতি কাজ থেকে। যা কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়।
আগেই বলেছি, ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশের মানুষ শান্তি প্রিয়। তারা শান্তিপূর্ণ যেকোনো কাজকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করেন। তাবলিগের শান্তিপূর্ণ নীতির কারণে বাংলাদেশের আপামর জনগণ দলমত নির্বিশেষে তাবলিগের কাজকে সমর্থন দিয়েছেন। এই বিপুল পরিমাণ মানুষ তাবলিগের এমন দ্বন্দ্বে দ্বিধাগ্রস্ত, তারা হতাশ। কারণ, কোনো ধর্মপ্রাণ মানুষ গভীর আস্থা, বিশ্বাস ও সম্মানের জায়গা থেকে মসজিদ, মাদরাসায় কোনো ধরনের গণ্ডগোল, কোন্দল, হাতাহাতি ও মারামারি প্রত্যাশা করেন না।
আশা করি, তাবলিগের বিবদমান গ্রুপ বিশেষ করে মাওলানা সাদের অনুসারীরা বিষয়গুলো মাথায় রেখে, মানুষের আস্থার প্রতিদান দেবেন। ধর্মীয় জায়গাগুলো ফেতনা থেকে দূরে রাখবেন। বিভিন্ন স্পর্শকাতর ইস্যুর সঙ্গে তাবলিগকে মিলিয়ে বিতর্কিত করবেন না।