হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হরজত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আমার সকল উম্মত জান্নাতে প্রবেশ করবে শুধু যে অস্বীকার করেছে সে ছাড়া। সাহাবাগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! কে অস্বীকার করবে? রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, যে আমার আনুগত্য করল; সে জান্নাতে যাবে আর যে আমার অবাধ্য হলো- সে অস্বীকার করল।’ -সহিহ বোখারি
বর্ণিত হাদিসের ভাষ্য অত্যন্ত পরিষ্কার। নবী করিম (সা.)-এর প্রকৃত উম্মতগণ জান্নাতে যাবে, কিন্তু যারা নবী করিম (সা.) কে মানবে না অথবা অস্বীকার করবে তাদের কী হবে? অপরদিকে যারা রাসূল (সা.) কে অনুসরণ করছে তারা কতটা করবে? এ ধরনের কিছু প্রশ্ন আমাদের সামনে আসে। সুতরাং আমরা এ সংক্রান্ত আলোচনা কোরআন-হাদিসের আলোকে উপস্থাপন করছি।
হাদিসের প্রথম অংশ ‘আমার সব উম্মত জান্নাতে প্রবেশ করবে’ এ অংশের সঙ্গে মানুষের অনেক কিছু জড়িত। তবে এ হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী পহেলা যে বিষয়টা এসেছে তা হলো, ‘যে আমার আনুগত্য করল।’ এই আনুগত্যের দাবি হলো- নবী করিম (সা.) দীর্ঘ ২৩ বছরে কোরআনের যত নির্দেশনা পেয়েছেন এবং নিজের বিবেকবুদ্ধি প্রয়োগ করে যে সব কাজ করেছেন তা সবই নিজের পরিমণ্ডলে বাস্তবায়ন করা। এ ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা সূরা হাশরের ৭ নং আয়াতে বলেন, ‘রাসূল যা কিছু তোমাদের দেন তা গ্রহণ করো এবং যে জিনিস থেকে তিনি তোমাদের বিরত রাখেন তা থেকে বিরত থাকো। আল্লাহকে ভয় করো। আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা।’
এ আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে রাসূল (সা.)-এর ওপর যে নির্দেশনা এসেছে তা অনুসরণ করতে হবে। সেক্ষেত্রে কোনো ছাড় নেই। যদি এমন কোনো ব্যাপার হয় যা আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে জড়িত, অথবা এ সংক্রান্ত কোনো বিষয় নিয়ে পরস্পরের মধ্যে বাদানুবাদ হয় তবে সেসব কিছুর সমাধানের জন্য মুমিনদেরকে সরাসরি আল্লাহর নির্দেশ এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পদ্ধতি অনুসরণ করতে বলা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! আনুগত্য করো আল্লাহর এবং আনুগত্য করো রাসূলের আর সেসব লোকের যারা তোমাদের মধ্যে দায়িত্ব ও ক্ষমতার অধিকারী। এরপর যদি তোমাদের মধ্যে কোনো ব্যাপারে বিরোধ দেখা দেয় তাহলে তাকে আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও। যদি তোমরা যথার্থই আল্লাহ ও পরকালের ওপর ঈমান এনে থাকো। এটিই একটি সঠিক কর্মপদ্ধতি এবং পরিণতির দিক দিয়েও এটিই উৎকৃষ্ট।’ -সূরা আন নিসা: ৫৯
যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আনুগত্য করবে সে আল্লাহতায়ালার আনুগত্য করল, আর যদি কেউ নবী করিম (সা.) কে বাদ দিয়ে জীবনের কোনো বিষয় বাস্তবায়ন করে তবে তা আল্লাহর দায় থেকে সে মুক্ত হয়ে যাবে। মহান আল্লাহ সূরা আন নিসার ৮০ নং আয়াতে বলেন, ‘যে ব্যক্তি রাসূলের আনুগত্য করলো সে আসলে আল্লাহরই আনুগত্য করলো। আর যে ব্যক্তি মুখ ফিরিয়ে নিলো, যাই হোক, তাদের ওপর তো আমি তোমাকে পাহারাদার বানিয়ে পাঠাইনি।’ মানব জীবনের সকল স্তরে যদি আল্লাহ নিদের্শিত এবং রাসূল (সা.) প্রদর্শিত নির্দেশাবলীর প্রতিফলন না ঘটে তবে তা হবে আনুগত্যহীন কাজ এবং তা এক পর্যায়ে মানুষকে কুফরির দিকে নিয়ে যায়। এ ব্যাপারে কোরআনে কারিমের নির্দেশনা হলো- ‘হে নবী! তাদেরকে বলুন, আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করো, তবে যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে নিশ্চই আল্লাহ এমন লোকদের মহব্বত করবেন না যারা আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য করতে অস্বীকার করে।’ -সূরা আল ইমরান: ৩২
হজরত রাসূল (সা.)-এর আনুগত্যের মাধ্যমে জান্নাত ও আল্লাহর রহমত পাওয়ার নিশ্চয়তা বিদ্যমান। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নামাজ কায়েম করো, জাকাত দাও এবং রাসূলের আনুগত্য করো, আশা করা যায়, তোমাদের প্রতি করুণা করা হবে।’ -সূরা আন নূর: ৫৬
তিনি আরও বলেন, ‘হে নবী! লোকদের বলে দাও, যদি তোমরা যথার্থই আল্লাহকে ভালোবাসো, তাহলে আমার অনুসরণ করো, আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গোনাহ মাফ করে দেবেন। তিনি বড়ই ক্ষমাশীল ও করুণাময়।’ তাদেরকে বলো, ‘আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করো।’ -সূরা আলে ইমরান: ৩১
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আনুগত্য করার ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর নির্দেশনা এসেছে কোরআনে কারিমে। নবী করিম (সা.) এর কোনো ফয়সালা, নিয়মাবলী ও কার্যাবলীর ব্যাপারে সামান্যতম কোনো ভিন্নতার মনোভাব পোষণ করলে তারা মুমিন হিসেবে গণ্য হবে না। মহান আল্লাহ বলেন, ‘না, হে মুহাম্মদ! তোমার রবের কসম, এরা কখনও মুমিন হতে পারে না, যতক্ষণ এদের পারস্পরিক মতবিরোধের ক্ষেত্রে এরা তোমাকে ফায়সালাকারী হিসেবে মেনে না নেবে, তারপর তুমি যা ফায়সালা করবে তার ব্যাপারে নিজেদের মনের মধ্যে যেকোনো প্রকার কুণ্ঠা ও দ্বিধার স্থান দেবে না, বরং সর্বান্তকরণে মেনে নেবে।’ -সূরা আন নিসা: ৬৫
হাদিসেও নবীর আনুগত্যের ব্যাপারে খুব জোরালো নির্দেশনা এসেছে। ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে আমার আনুগত্য করল সে আল্লাহর আনুগত্য করল। আর যে আমার হুকুম অমান্য করল সে আল্লাহর হুকুমই অমান্য করল। আর যে আমিরের আনুগত্য করল সে আমারই আনুগত্য করল। যে আমিরের আনুগত্য করল না সে আমাকে অমান্য করল।’ –সহিহ বোখারি ও মুসলিম
নবী করিম (সা.)-এর আনুগত্য ও তার অনুসরণ করা ওয়াজিব। সুতরাং উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, জান্নাতি মানুষ হবার জন্য কখনই আল্লাহ এবং রাসূলের সামান্যতম বিরোধিতা করা যাবে না।
হাদিসের শেষাংশ ‘যে অস্বীকার করল।’ কে অস্বীকার করল? সাহাবাদের এমন প্রশ্নের উত্তরে রাসূল (সা.) বললেন, ‘যে আমার অবাধ্য হলো বা আমাকে অমান্য করল।’ সুতরাং আমাদের কাছে দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট যে, নবী করিম (সা.)-এর উম্মতের মধ্যে জান্নাতে যাবে না শুধুমাত্র সে, যে ‘রাসূলের অবাধ্য হয়েছে এবং তাকে অমান্য করেছে।’
এক্ষেত্রে নিম্নেবর্ণিত বিষয়গলো নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। যেমন-
ক. আমরা ফরজ ওযাজিব আমলগুলো কতটা গুরুত্বের সঙ্গে করি?
খ. আমাদের আর্থিক জীবনে হালাল-হারাম, সুদ-ঘুষ, ন্যায়-অন্যায় কতটা দেখে চলি?
গ. একজন ছাত্র, শিক্ষক, এমপি, মন্ত্রী, সচিব, পরিবারের কর্তা এবং দায়িত্বশীল হিসেবে আমার ওপর অর্পিত আমানত কতটা পুরো করি?
ঘ. সামাজিক জীবনে সকলের অধিকারের কতটুকু আদায় করতে পারি?
ঙ. আমাদের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে রাসূল (সা.)-এর কতটুকু অনুসরণ করি?
চ. যারা আল্লাহর দ্বীন প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে তাদের কতটা বিরোধিতা করি?
ছ. আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন কায়েমের জন্য আল্লাহতায়ালার দেওয়া সময়, অর্থ, মেধা এবং শ্রম দেওয়ার জন্য আমরা কতটা উদগ্রীব?
এ জাতীয় বিষয়গুলো সবসময় ভাবতে হবে। সে ভাবনা নবী করিম (সা.)-এর দেখানো পথে হতে হবে, অন্যথায় আমাদের অজান্তেই রাসূল (সা.) কে অমান্যকারিদের কাতারে শামিল হয়ে যেতে পারি এবং জান্নাতে যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
হাদিসের শিক্ষা
১. সর্বাবস্থায় আল্লাহ এবং রাসূল (সা.)-এর আনুগত্য করার মাধ্যমে জান্নাতে যাওয়ার পথ সুগম করতে হবে।
২. হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সিরাত সবসময় অধ্যয়ন করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় তথ্যাবলী যথাযথভাবে মনে রাখতে হবে।
৩. ব্যক্তিগত, সামাজিক, পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় সব পর্যায়ে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কর্মনীতি অনুযায়ী কাজ করতে হবে।
৪. সর্বোপরি কোনো কাজ করার আগেই ভাবতে হবে- এটা কী নবী (সা.)-এর দেখানো অথবা করণীয় পদ্ধতিতে হচ্ছে?