ইসলাম-মুসলমানদের সঙ্গে ‘চরমপন্থা’ যায় না

  • মাহফুজ আবেদ, অতিথি লেখক, ইসলাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ, ছবি: সংগৃহীত

বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ, ছবি: সংগৃহীত

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, ‘বাংলাদেশে ইসলামি চরমপন্থা আসবে না।’ প্রভাবশালী ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি একথা বলেছেন।

বাংলাদেশ ২০২৪ সালে ইকোনমিস্টের বর্ষসেরা দেশ নির্বাচিত হয়েছে। সবচেয়ে সুখী বা ধনী নয় বরং গত ১২ মাসে কোন দেশ সবচেয়ে বেশি উন্নতি করেছে, সেই বিচারে বর্ষসেরা দেশ বেছে নেওয়া হয়। বাংলাদেশকে বর্ষসেরা দেশের খেতাব দেওয়ার ক্ষেত্রে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতন ও বাংলাদেশের নবযাত্রা শুরুর বিষয়টিকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এই প্রেক্ষিতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ইকোনমিস্টের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক প্যাট্রিক ফোলিস।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশ বর্ষসেরা খেতাব পাওয়ায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতিক্রিয়া জানতে চান প্যাট্রিক ফোলিস। উত্তরে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আমরা অত্যন্ত আনন্দিত, অত্যন্ত গর্বিত। সত্যিকার অর্থেই আমরা একটি বড় পরিবর্তন ঘটিয়েছি। ছাত্রদের কারণেই অভ্যুত্থান ঘটেছে। তখন থেকে আমরা বলছি, একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চাই।’

এ সময় প্যাট্রিক ফোলিস জানতে চান, বাংলাদেশে ইসলামি চরমপন্থা ফিরে আসার কিছু ঝুঁকি রয়েছে বলে মনে করেছেন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের কর্মকর্তারা, বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন? জবাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানান, ‘বাংলাদেশে এমন কিছু ঘটতে যাচ্ছে না।’

বিজ্ঞাপন

উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাদেশের প্রকৃত চিত্র যেটা; সেটাই তুলে ধরেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশ বাংলাদেশ। বাকীরা হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও অন্যান্য। শত শত বছর ধরে তারা পাশাপাশি বসবাস করেছে শান্তি ও সম্প্রীতির সঙ্গে। তাদের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ, বিরোধ-সংঘাত ধর্মীয় কারণে কখনোই দেখা যায়নি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির রোল মডেল হিসেবে বাংলাদেশ পরিচিত। এই যে সম্প্রীতি ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ, এর পেছনে নিয়ামক ভূমিকা রয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের।

ইসলাম তাদের অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোকদের প্রতি সদাচার ও সমতা প্রদর্শনের শিক্ষা দিয়েছে। মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখতে শিক্ষা দিয়েছে, হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান হিসেবে নয়। রাষ্ট্রীয় ও মানবিক অধিকারের ক্ষেত্রে তাদের প্রতি বিষম আচরণ করতে সম্পূর্ণ নিষেধ করেছে। এদেশের মুসলমানরা যুগের পর যুগ ধরে ইসলামের এই নির্দেশনা ও শিক্ষা অনুসরণ করে আসছে। তার মতই অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষও সহিষ্ণু, সুহৃদয়, পারস্পরিক ভ্রাতৃসম্মন্ধে আবদ্ধ। এ কারণেই বাংলাদেশ শান্তি ও সম্প্রীতির অনন্য দেশ হিসেবে খ্যাতে হয়ে আছে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস কেন এদেশে ইসলামি চরমপন্থা আসবে না বলে ঘোষণা দিয়েছেন, তা সহজেই অনুমেয়। বাংলাদেশের মানুষের ব্যাপারে তার অভিজ্ঞতা, পঠন-পাঠন তাকে বলে দিয়েছে, বাংলাদেশে ইসলামি কেন, কোনো ধরনের চরমপন্থার উত্থানের আশঙ্কা নেই। স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর হাসিনা ও মোদি মিলে সংখ্যালঘু কার্ড খেলছেন, একের পর এক হিন্দু নির্যাতনের কল্পিত কাহিনী প্রচার করে বাংলাদেশকে বহির্বিশ্বে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করছেন। হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে দাঙ্গা বাঁধানোর অসৎ উদ্দেশ্যও তাদের রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। কিন্তু তাদের এই যৌথ অপচেষ্টা এদেশের জাগ্রত ছাত্র-জনতা, আলেম-উলামা, ইমাম-খতিব, রাজনৈতিক দল ও সরকার সফলভাবে প্রতিহত করেছে ও করে যাচ্ছে।

স্মরণ করা যেতে পারে, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা গত সাড়ে ১৫ বছর ধরে ইসলামি চরমপন্থার জুজুর ভয় দেখিয়েছেন। মাঝে মাঝেই ‘জঙ্গি’ ধরার নাটক করেছেন। নিজের অপকর্মকে ঢাকা দেওয়া ও ক্ষমতা নিরাপদ করার জন্য এটাকে কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার অন টেরর শুরুর পর থেকে বিশ্বব্যাপী ইসলামি চরমপন্থী খোঁজা আরম্ভ হয়েছে। বিভিন্ন মুসলিম দেশে আগ্রাসন চালানো হয়েছে। নির্বিচারে মানুষ হত্যা করা হয়েছে। বাড়িঘর ও স্থাপনা ধ্বংস করা হয়েছে। ধন-সম্পদ লুট করা হয়েছে। আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়াকে রীতিমত ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। নানা রকম কাহিনী ও গল্প সৃষ্টি করে বিশ্ববাপী ইসলামোফোবিয়ার বিস্তার ঘটানো হয়েছে। মুসলমানদের সভ্যতার শত্রু ও মানবতার দুশমন হিসেবে প্রতিপন্ন করা হয়েছে। ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি চরম বিদ্বেষই এর মূলে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অকুণ্ঠ ধন্যবাদ যে, তিনি কথিত ইসলামি চরমপন্থার জুজুকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করেছেন। সৎসাহসের সঙ্গে সত্য উচ্চারণ করেছেন। কে না জানে, এ দেশের মুসলমানরা কখনোই চরমপন্থা পছন্দ করে না। এখানে ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা হয়েছে সুফি-দরবেশদের দ্বারা, যারা ছিলেন বিনয়ী, অসম্প্রদায়িক, মানবিক, সহৃদয় এবং চরিত্রমাধুর্যে অতুলনীয়। এদেশের মানুষ তাদের উত্তরাধিকার বংশপরম্পরায় বহন করছে। অতীতে কখনো কখনো বিপথগামী হয়ে কেউ কেউ বা কিছু লোক চরমপন্থা অনুসরণের চেষ্টা করেছে বটে, তবে তারা সফল হয়নি। দেশের আলেম-উলামা, পীর-মাশায়েখ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। এটাই দেশের মানুষের প্রকৃত চরিত্র। এটাই বাংলাদেশ।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই বাংলাদেশের কথাই বলেছেন। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, হাসিনা সরকারের সময়ে বাংলাদেশে ইসলামি চরমপন্থা উত্থানের আশঙ্কা নিয়ে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা ছাড়াও গ্রন্থাদি রচনা করে বিলি করা হয়েছিল। কিছু পত্র-পত্রিকা বিভিন্ন সময়ে একই প্রচারণা চালিয়েছে। এসব যে নিতান্তই মিথ্যা, বানোয়াট ও বিশেষ উদ্দেশ্যমূলক ছিল, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার দৃঢ় উচ্চারণের মধ্য দিয়ে চিরায়ত বাংলাদেশ ও তার অধিবাসীদের প্রকৃত পরিচয় সুস্পষ্ট করেছেন। সরকারের বহিঃপ্রচার বিভাগের উচিত, বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরার জন্য প্রচার-প্রচারণা ও গ্রন্থাদি প্রকাশ করা, যাতে বাংলাদেশ সম্পর্কে আসল ধারণা বিদেশিরা পেতে পারে।

মনে রাখতে হবে, ইসলামি চরমপন্থার বিষয়টি আসলে একটি বিদেশি প্রোপাগান্ডা। দেশের ভেতরেও এই প্রোপাগান্ডার কিছু দোসর আছেন। আগেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশ কেমন দেশ- তা সব চাইতে ভালো জানেন এ দেশের নাগরিকরা।

ইসলাম এমন একটি ধর্ম, যার সঙ্গে ‘চরমপন্থা’ কোনোভাবেই যায় না। ইসলাম হলো- শান্তির ধর্ম, অন্য ধর্মের মানুষের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলা এ ধর্মে বড় পাপ। তাই ভারতীয় গণমাধ্যমের উসকানিমূলক প্রোপাগান্ডার মধ্যেও বাংলাদেশর মুসলিম নাগরিকরা শান্ত ছিলেন, সংযত ছিলেন। গোটা বিশ্ব তা দেখেছে। তবে যারা মন্দ মতলবে প্রোপাগান্ডা চালাতে চান, তাদের বোধোদয়ের জন্য আমরা প্রার্থনা জানাই।