পৃথিবীর সূচনাকাল থেকেই আলো-আঁধার সমান্তরালভাবে পথ চলছে। তবে আলোর পরশে আঁধার বিদুরিত হয়েছে, এটাই ধ্র্রুব সত্য। এরই ধারাবাহিকতায় হেদায়েতের মশাল নিয়ে আগমন ঘটে নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের। তার আগমনের সময় চরম আঁধারে ডুবে ছিল আরবসহ সমকালীন বিশ্ব। যে যুগকে ইতিহাসে আইয়্যামে জাহেলিয়াত তথা অন্ধকার যুগ বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে ইতিহাসের পাতায়।
ওই যুগের বর্বরতার মাত্রা অন্যসব সময়কে ছাড়িয়ে যায়। বিভীষিকাময় ওই পরিস্থিতিতে কি ছিল আর কি ছিল না তাদের জীবনে- এমন পার্থক্য করা কঠিন। মদ, জুয়া, ব্যভিচার, হত্যা, লুণ্ঠন, গোত্রীয় গৌরব, আত্মঅহমিকা ও স্বজনপ্রীতির বিষবাষ্পে বিষিয়ে উঠে ওই সমাজ। অবশেষে আল্লাহতায়ালার রহমতে অবসান হয় বর্বর এ যুগের। আগমন ঘটে রবিউল আউয়াল মাসে আখেরি নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের। যার আগমনে নিভে যায় পারস্যের অগ্নিকুণ্ড। ফাটল ধরে রোমের রাজ প্রাসাদে। ধীরে ধীরে বিকশিত হতে থাকে নবীর জীবন শোভা।
৪০ বছর বয়সে তিনি নবুওয়তপ্রাপ্ত হন হেরাগুহায়। হেরার সে আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে সময় ও সমাজ, দেশ ও জাতি। এক সময় ওই আলো মক্কা ছাড়িয়ে, মদিনা মাড়িয়ে পৌঁছে যায় দিগ-দিগন্তে, পৃথিবীর ছত্রে ছত্রে; দুনিয়ার কোষে কোষে। হেরা গুহার ওই আলোর ছায়া ও ছোঁয়ায় প্রতিমাবিশ্বাসীরা হয়ে যায় এক আল্লাহর একনিষ্ঠ অনুসারী। মানব হত্যাকরীরা পরিণত হয় মানবকূলের জীবন রক্ষাকারী সিপাহসালার। আত্মঅহমিকা ভুলে নম্রতা, শিষ্টাচার আর আচার-আচরণে একেকজন পরিণত হয় আদর্শ মানবে। লোভ-লালসা ছেড়ে অভ্যস্ত হয়ে যায় অল্পতুষ্টিতে। আস্থা, ন্যায় পরায়ণতা, নীতি-নৈতিকতার শান্তিময় সামিয়ানায় আবৃত হয় ওই সমাজ। প্রিয় নবীর স্পর্শ ও সান্নিধ্যে বর্বর আরবরা পরিণত হয় সভ্য জাতিতে। আহ! কী নির্মল ছিল সে জাতি, ওই সমাজ এবং পরিবেশ।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে ওই আলোর দূর্বার গতি। নবুওয়তের দীর্ঘ ২৩ বছরে পূর্ণতা লাভ করে সে আলো। ইতিহাস সাক্ষী, স্বচ্ছ হৃদয়ে যে যতটা কাছ থেকে সে আলোর ছটা, ছায়া ও ছোঁয়া পেয়েছে- সে অতটুকুই পরিপূর্ণ মানবে পরিণত হয়েছেন।
শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে গেলে আজও মানব সম্প্রদায়ে হেরার ওই জ্যোতি উদ্ভাসিত আপন মহিমায়। এটাই আল্লাহর কুদরত ও কোরআনে কারিমের মুজিজা। কোরআনের আলোকিত বিধান, প্রিয় নবীর আলোকময় জীবনালেখ্যই হেরার আলো। আফসোসের কথা হলো- আমরা সরে যাচ্ছি সে আলো থেকে। সরে যাচ্ছি না বলে, বলা উচিত- আধুনিকতা, স্বার্থান্ধতা, ভ্রান্ত নীতিচর্চা, ধর্মহীন শিক্ষা ও সমাজ ব্যবস্থা আমাদের সরিয়ে রাখছে।
আজ আমাদের সমাজে সব আছে, শুধু নেই হেরার সেই আলোর ছটা। হৃদয় আছে, স্পন্দন নেই। দেহ আছে, প্রাণ নেই। শব্দ আছে, মর্ম নেই। সুরত আছে সীরাত নেই। আমরা নবীজির নূরানী আলো ছেড়ে খুঁজে বেড়াচ্ছি অবক্ষয়ের পথ। এটা তিক্ত সত্য কথা।
তবুও আমরা নিরাশ নই, হতাশ নই। কারণ আমাদের মালিক শিখিয়েছেন, ‘তুমি চিন্তিত হয়ো না, নিশ্চয় আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন।’ এখনও কোরআন-সুন্নাহ আছে আমাদের মাঝে এবং থাকবে কিয়ামত পর্যন্ত। আমাদের মাঝে কোরআনের ধারক-বাহকরা রয়েছেন।
তবে এটা সত্য যে, এখন ধীরে ধীরে পৃথিবী থেকে মানব জীবনের স্বাভাবিক রুচিবোধ বিলীন হয়ে যাচ্ছে। স্বচ্ছ, সরল ও পবিত্র রুচিবোধ হারিয়ে যাচ্ছে। উন্নত রাষ্ট্রগুলো বিজ্ঞানের কল্যাণে যান্ত্রিকজীবন যাপনে অভ্যস্ত হচ্ছে। যেখানে না আছে সুখ, না সুখের ছায়া। আধুনিকতার প্রলোভনে, কথিত উন্নত জীবনের সন্ধানে আমরাও বিলিয়ে দিচ্ছি আমাদের স্বকীয়তা, ধর্ম ও আদর্শকে। আর যাই হোক, একজন মুমিন এমন পথ বেছে নিতে পারেন না।
সত্যিকার অর্থে মানুষের জীবনের প্রকৃত সুখ ও সফলতা হলো- ইসলামে, কোরআনের অনুসরণে; প্রিয় নবীর আলোমকয় আদর্শে, তার জীবন অনুসরণে। যে জীবন সাজানো হেরার সেই উজ্জ্বল আলোয়। দুনিয়ার সব মানুষের উচিৎ হেরার আলোয় নিজেকে আলোকিত করা। কারণ, ওই জীবনেই রয়েছে চিরস্থায়ী সুখ ও সফলতা।
মুহাম্মদ হাসান মুরাদ: শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম বুজরুকগড়গড়ী, চুয়াডাঙ্গা।