ধর্ম-কর্ম পালন ও রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। কিন্তু ধর্ম রক্ষা করতে গিয়ে ‘অধর্ম’ কর্মকাণ্ড করা কখনোই ধর্ম নয়। আমাদের জানার এতোই কী অভাব যে, কাউকে বুঝানোর জ্ঞান পর্যন্ত নেই। চিলে কান নিয়েছে, এখন কানে হাত না দিয়েই কী চিলের পেছনে দৌঁড়াতে হবে?
গত ২৯ অক্টোবর লালমনিরহাটের পাটগ্রামে কোরআন অবমাননার দায়ে গুজবে ভর করে শহিদুন্নবী জুয়েল নামের একজনকে হত্যা করে পুড়িয়ে দিয়েছে অতি উৎসাহী একশ্রেণির জনতা। এ ঘটনায় মামলা সংশ্লিষ্টদের পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। শুরু হয়েছে আইনি নানা পদক্ষেপ। এখনও প্রমাণ মেলেনি জুয়েল কর্তৃক পবিত্র কোরআন অবমাননার অভিযোগের বিষয়ে।
অভিযোগটি মিথ্যাও হতে পারে! যদি এমন হয়, কোনো কারণে প্রতিপক্ষ লোকটিকে ফাঁসাতে নাটক সাজানো হয়েছে, কিংবা কোনো পক্ষ কোনো স্বার্থ হাসিলের নিমিত্তে কাজটি করেছে! আর কতিপয় মানুষ স্পর্শকাতর বিষয়টি নিয়ে কোনো কিছু না ভেবে তীব্র ক্ষোভ থেকে তাকে মেরে ফেললো! যেমনটা প্রায়ই ঘটে। আর পথে-ঘাটে কাউকে ফাঁসাতে পকেট মার, ছিনতাইকারী, চোর বলে গণধোলাই দিয়ে প্রতিশোধ নেওয়ার ঘটনা দেশে নতুন নয়। যে শান্তির ধর্ম ইসলাম ও পবিত্র কোরআন মানুষকে আলোর পথ দেখায়, সে ধর্মের দোহাইয়ে যদি কাউকে পুড়িয়ে মারা হয়, তাহলে ধর্ম শিক্ষাইতো আমাদের বৃথা!
দু-একজন জ্ঞানের অভাবে হয়তো কোনো অপ্রচার ছড়িয়ে ছিলো। এর পরিণতিতে হাজারও মানুষ নিজেদের জ্ঞানী ও ধার্মিক প্রমাণ করতে বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড ঘটাবে? বিনা প্রমাণে ও বিচারে হত্যাকাণ্ড ইসলাম সমর্থন করে না। কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণের দায় ইসলাম কখনোই নেবে না। ইসলাম অবমাননাকারী ব্যক্তিকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। কিন্তু এভাবে হুটহাট গণপিটুনি দিয়ে?
পৃথিবীতে ধর্ম আর সভ্যতা নিয়ে একমাত্র মুসলমানরাই বড়াই করে থাকে। এর বিপরীতে কতিপয় মূর্খের আচরণ এখন ইসলামের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুসলমান ও ইসলামের সম্মানহানী হয়। আমরা আমাদের নিজেদের অজান্তে ইসলামকে কলুষিত করি। ধর্মের নামে উগ্রতাকে কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এ সব ঘৃণিত কাজ ইসলাম কোনো দিন সমর্থন করে না। সাক্ষী প্রমাণ ছাড়া পিটিয়ে মারা এবং আগুনে পুড়িয়ে ফেলা ইসলামে বৈধ নয়। ইসলাম জোর জবরদস্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ইসলাম প্রচার, প্রচার এবং মানুষের গ্রহণ এসেছে ভালোবাসা দিয়ে। মেহেরবান আল্লাহ মানুষতো দূরের কথা, একটা মশাকেও পুড়িয়ে মারার নির্দেশ দেয়নি। যুদ্ধ ও আত্মরক্ষার জন্য ছাড়া কাউকে আঘাত করা ইসলাম সমর্থন করে না।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, মানসিক ভারসাম্যহীনতা থাকলেও ইসলামিমনা পরিবারের সন্তান ছিলেন জুয়েল। ফজরের নামাজ আদায় করে এলাকার রাস্তা পরিষ্কার করতেন। শিশু, চেতনাহীন, মানসিক ভারসাম্যহীন ও পাগলদের আমলনামা লেখা হয় না। কারণ, তারা নিজের ইচ্ছাতে কিংবা সজ্ঞানে কিছুই করে না। তাই তাদের ওপর শরিয়তের কোনো হুকুম প্রযোজ্য নয়। কোরআনের প্রতি সম্মান দেখাতে গিয়ে কতিপয় অতি উৎসাহী, নোংরা মানসিকতার জ্ঞানহীন মানুষ লাশ পুড়িয়ে নিজেরাই ফের কোরআনের অবমাননা করলো। এজন্য ধর্ম আবেগ দিয়ে পালন না করে, মগজ দিয়ে পালন করা শিখতে হবে। ধর্ম নম্র, ভদ্র, ধৈর্যশীল হতে শেখায়, ক্ষমা ও ভুল মেনে নিতে শেখায়। কোরআন অবমাননা মেনে নেওয়ার মতো বিষয় নয়, তবে সেখানে কোনো গুজব বা ষড়যন্ত্র আছে কিনা তা সঠিকভাবে যাচাই করতে হবে।
নিহত শহীদুন্নবী রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক গ্রন্থাগারিক। রংপুর জিলা স্কুল থেকে এসএসসি পাসের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। তার দুই ছেলে-মেয়ে। বড় মেয়ে এবার এইচএসসি পাস করেছেন ও ছেলে ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী। জুয়েলের স্ত্রী জেসমিন আক্তার মুক্তা বলেন, ‘আমার স্বামী অনেক সহজ-সরল ছিলো। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো, কোরআন-হাদিস পড়তো। প্রত্যেক বছরই তিন-চারবার করে কোরআন খতম দিতো। করোনা ভাইরাসের সময় কয়েকবার কোরআন খতম দিয়েছে। আগামী বছর আমাকে নিয়ে হজে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আমি বিশ্বাস করি না সে কোনোভাবেই কোরআন অবমাননা করতে পারে। যারা গুজব ছড়িয়ে আমার স্বামীকে হত্যা করেছে আমি তাদের বিচার চাই।’
জানা গেছে, সম্পূর্ণ ইসলামিমনা পরিবারের সন্তান জুয়েল মানসিক ভারসাম্যহীনতায় ভুগছিলেন। তবে নামাজি এবং কোরআন অবমাননা করার মতো ছিলেন না বলে পরিবার এবং স্থানীয়রা জানিয়েছেন। স্বামীর মৃত্যুতে তসবিহ হাতে আহাজারি করতেও দেখা গেছে জুয়েলের স্ত্রীকে। শহিদুন্নবী জুয়েলের ঘরে এখনও সমুন্নত রয়েছে কোরআন। রয়েছে বিভিন্ন দোয়া ও হাদিসের বইও। তাহলে কেন এই বীভৎস হত্যাকাণ্ড? শুধুই গুজব নাকি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড? পরিকল্পিতই যদি হয় তাহলে এর নেপথ্যে কাদের ইন্ধন রয়েছে- এসব প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে সচেতন মহলে।
আরেকটি কথা, ধর্ম অবমাননার বিচার কার হাতে? ধর্মে তো সুদ, ঘুষ, মদ, বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক হারাম। এছাড়া যারা মানুষ ঠকিয়ে ব্যবসা করে, খাবারে ভেজাল মেশায়, অবৈধভাবে অর্থ আয় করে, মিথ্যা বলে, প্রতারণা করে- তারাও তো ধর্মের অবমাননা করছে। তাহলে তাদের কেন পিটিয়ে মেরে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় না। তাদের বিরুদ্ধে মিছিল-মিটিং হয় না? কেউ যদি আল্লাহর প্রতি পূর্ণবিশ্বাস রাখে, তাহলে সে কখনও বিনাবিচারে অপরকে হত্যা করতে পারে না। কারণ, এতে সমাজে, রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা চরম আকার ধারণ করবে। বিচারের মালিক আল্লাহ আর আদালত। কেউ যদি সেই বিচারের ভার নিজের হাতে তুলে নেয় তাহলে সে আল্লাহর হুকুম ও প্রচলিত আইনের লংঘন করলো। আর ধর্ম অবমাননার অভিযোগ উঠলে শাসক ছাড়া সাধারণ জনগণ তাকে শাস্তি দিতে পারে না।
ধর্ম অবমাননা অবশ্যই গর্হিত কাজ। কিন্তু কেউ ধর্ম অবমাননা করলে ধর্ম ছোট হয় না। একটা গুজবের জন্য মানুষ পুড়িয়ে মারলে মনুষ্যত্ব ছোট হয়। শহীদুন্নবী জুয়েলকে পুড়িয়ে মেরে ধর্মের সম্মান বাড়েনি।
হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কেউ ব্যঙ্গবিদ্রুপ কিংবা গালিগালাজ করলে মুসলমানদের মন কাঁদে, হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয়। পবিত্র কোরআনকে অবমাননা করলে মুসলমানদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এহেন মুহূর্তে ধৈর্য ও ইমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। রাসূলের সময়ে তাকে অসম্মান, গালাগালি কিংবা কোরআনকে অবমাননা করা হয়নি? সে সময় কি হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ওই সব ইহুদি-নাসারা কিংবা মুশরেকদের পিটিয়ে মেরেছিলেন? আমরা প্রতিবাদ করবো, ঘৃণা করবো কিন্তু আমরা কি হত্যা করতে পারবো? উশৃঙ্খল, বাজে, বর্বর আচরণে কী ধার্মিকতা প্রকাশ পায়?
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, শপথ সেই মহান সত্তার! যার হাতে আমার প্রাণ। দুনিয়া ততক্ষণ পর্যন্ত ধ্বংস হবে না (তার পূর্বে) মানুষের প্রতি এমন একসময় আসবে, হত্যাকারী জানবে না সে কেন হত্যা করছে, আর নিহত ব্যক্তি জানবে না তাকে কেন হত্যা করা হয়েছে। বলা হলো, সেটা কীভাবে হবে? বললেন, হারাজ (গুজব, হুজুগ, অলীকতা, বিবেকহীনতা, মূর্খতা, নির্বুদ্ধিতা, অন্যায় হত্যা, বিচারহীনতা ও সত্য মিথ্যার মিশ্রণ ইত্যাদি)-এর কারণে। -সহিহ মুসলিম: ৩৯০৮
অতি আবেগী হওয়া কাম্য নয়। ইসলাম এতো নিষ্ঠুরতম আচরণ করতে বলেনি। ইসলাম শান্তির ধর্ম। নবী করিম (সা.) বারবার আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার পরে আল্লাহতায়ালা বলেছিলেন, ‘হে নবী আপনি একবার বলুন, আমি এই সমগ্র জাতিকে ধ্বংস করে দেবো। কিন্তু দয়াময় রাসূল (সা.) ধ্বংস না চেয়ে তাদের হেদায়েত কামনা করেছিলেন।’ মনে রাখতে হবে, ইসলাম আমাদের এ শিক্ষাই দিয়ে থাকে।
সরকারের উচিৎ লালমনিরহাটের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন না হয় সে দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা। ধর্ম অবমাননার বিরুদ্ধে কঠিন আইন করা এবং এর যথাযথ প্রয়োগ করা। বিশেষ ট্রাইবুনালের মাধ্যমে দ্রুত বিচার করা। তাহলে এ সমস্যা অনেকাংশেই কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক ধর্মীয় সুরক্ষাও নিশ্চিত হবে।