সৎকর্ম, ভ্রাতৃত্ববোধ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষায় কোরআনে কারিমের আয়াত উদ্ধৃতি করে দেওয়া রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের ভাষণ নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেওয়ার সময় প্রেসিডেন্ট পুতিন পবিত্র কোরআনের দু’টি সূরার দু’টি আয়াতের তরজমা উদ্ধৃত করেন।
রাশিয়ার গণমাধ্যমগুলো বলছে, রাশিয়ার জাতীয় সংহতি দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট পুতিন বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে মুসলিম, ইহুদি, খ্রিস্টান ও হিন্দু ধর্মের প্রধানরা উপস্থিত ছিলেন। বক্তব্যে রুশ প্রেসিডেন্ট পবিত্র কোরআনের সূরা আশ শুরার ২৩ নম্বর আয়াত এবং সূরা আন নাহলের ১২৮ নম্বর আয়াতের রাশিয়ান ভাষায় তরজমা উদ্ধৃত করে সৎকর্ম, ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্ব এবং এর পুরস্কার সম্পর্কে কথা বলেন।
এবারই প্রথম নয়, এর আগেও প্রেসিডেন্ট পুতিন কোরআনে কারিমের আয়াতের তরজমা উদ্ধৃত করে ভাষণ দিয়েছেন। ২০১৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বরে তুরস্কের রাজধানী আংকারায় অনুষ্ঠিত তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান ও ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানিসহ তিন দেশের শীর্ষ কূটনীতিকদের সামনে ইয়েমেন যুদ্ধের ব্যাপারে আরব নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ‘আরব উপদ্বীপের শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতি ফিরিয়ে আনতে ইয়েমেন যুদ্ধের অবসান প্রয়োজন।’ এ সময় তিনি সূরা আলে ইমরানের ১০৩ নম্বর আয়াতের ‘তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ করো, যখন তোমরা ছিলে পরস্পরের শত্রু। অতঃপর তিনি তোমাদের অন্তরে সদ্ভাব সৃষ্টি করলেন, ফলে তার অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই হয়ে গেলে’ অংশটুকু উদ্ধৃত করেন।
রুশ প্রেসিডেন্টের কোরআনের এই আয়াত পাঠের প্রতি প্রেসিডেন্ট এরদোগান ও রুহানি সমর্থন জানান। পবিত্র কোরআনের ওই আয়াতে ইসলামপূর্ব আরবদের অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। মানবজাতিকে শান্তি ও সৌহার্দের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
এদিকে চলতি বছরের ৩১ অক্টোবর রুশ প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ ‘রাশিয়াকে আংশিক মুসলিম রাষ্ট্র’ উল্লেখ করে বক্তব্য দিয়ে ফ্রান্স কর্তৃক নবী করিম (সা.)-এর ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শনের ঘটনার নিন্দা জানান।
তিনি বলেন, ‘রাশিয়া আংশিক মুসলিম রাষ্ট্র; এখানে দুই কোটির বেশি মুসলিম বাস করে। আমাদের বেশিরভাগ মানুষ খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী হওয়ায় দেশটির প্রধান ধর্ম হলো- খ্রিস্টধর্ম। আমাদের দেশের স্বতন্ত্রতা এর বহুজাতিগত এবং বহুধর্মীয় প্রকৃতিতে স্পষ্টভাবে রয়েছে এবং সব ধর্ম একে অপরের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধায় বসবাস করে।’
রুশ প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র আরও বলেন, ‘ইসলামের নবী (সা.)-এর অবমাননা করার কারণে ফ্রান্সে সহিংসতা বেড়ে গেছে। কাজেই সবার আগে এ ধরনের অবমাননাকর কার্যকলাপ বন্ধ করতে হবে।’
ফ্রান্সের বিতর্কিত শার্লি এবদোর মতো কোনো সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয় উল্লেখ করে রুশ প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র বলেন, ‘রাশিয়ায় ইসলামবিদ্বেষী প্রচারণা মেনে নেওয়া হবে না। রাশিয়ার রাষ্ট্রব্যবস্থার কারণে দেশটির ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে এমন কোনো গণমাধ্যমের অস্তিত্ব থাকা সম্ভব না।’
দিমিত্রি পেসকভের মতে, ‘কোনো ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি অবমাননা ও ধর্মপ্রাণ জনগোষ্ঠীর অনুভূতিতে আঘাত হানা রাশিয়ার দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়।’
ফ্রান্সের ঘটনার প্রেক্ষিতে দেওয়া রুশ প্রেসিডেন্টের মুখপাত্রের বক্তব্য, মধ্যপ্রাচ্যে বিষয়ে রাশিয়ার দৃশ্যমান অবস্থান এবং ফিলিস্তিন সংকটসহ বিভিন্ন বিষয়ে পুতিনের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে বলা চলে, ইসলাম ধর্ম ও মুসলমানদের বিষয়ে রাশিয়া দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে। এটা অনেকটা বিস্মিত হওয়ার মতো ঘটনা। বিশ্ব রাজনীতির কারণে হোক, শক্তি সঞ্চয় কিংবা পাল্লা ভারি করার কৌশল হোক- এটাকে ইতিবাচকভাবেই দেখা দরকার।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাশিয়ার মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে ইসলাম ও অন্যান্য ধর্ম সম্পর্কে দেশটির উদারনৈতিক মনোভাব প্রকাশিত হয়েছে। নানা কারণে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে আলোচনা ও সংলাপকে রাশিয়া বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে অব্যাহত সংলাপ এখন পুতিনের বিদেশনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে যে কৌশলগত পদক্ষেপ রাশিয়া নিয়েছে, তা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে।
ইসলাম রাশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম। আর সেটা যে তাদের অহংকার, পুতিন সরকার তা বিশ্বের সামনে নানাভাবে চিত্রিত করার প্রয়াস চালান। রাশিয়ায় ধর্ম সম্পর্কে লেনিনের দৃষ্টিভঙ্গিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিহার করে ধর্মকে স্বীকৃতি দেওয়ার রীতি পুতিন শুরু করেছেন। তিনি বন্ধ থাকা মস্কোর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ বিপুল অর্থব্যয়ে আধুনিকায়নের পর চালু করেছেন। মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানদের উপস্থিতিতে মস্কোর গ্র্যান্ড মসজিদ উদ্বোধন করে পুতিন বলেছিলেন, ‘আমি ইসলামি আধ্যাত্মিক নেতাদের সাহায্য চাই, ‘জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় উগ্রপন্থার’ বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাদের ভূমিকা বিরাট পরিবর্তন বয়ে আনতে পারে।’
রাশিয়ায় ইসলাম প্রবেশ করে প্রায় হাজার বছর আগে। রাশিয়ায় কিছু কিছু এলাকাতে ইসলাম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্ম। অথচ একটা সময় ছিল, রাশিয়ার অধীনে মুসলিমদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা ছিল না। তাদের ধর্মীয় অধিকার সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। তাদের অর্থনীতি শোষিত হচ্ছিল রাশিয়া কর্তৃক। ১৯১৭ সালে কমিউনিস্ট বলশেভিকরা রাশিয়ার ক্ষমতা দখল করে। তারা কমিউনিজম ও নাস্তিক্যবাদ চাপিয়ে দেয়। রাজনৈতিক পরাধীনতা এবং অর্থনৈতিক শোষণ ছাড়াও ইসলামকে কার্যত নিষিদ্ধ করা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৯১ সালে ভেঙে যাওয়া পর্যন্ত এ অবস্থা চলতে থাকে।
বর্তমানে রাশিয়ায় মুসলমানরা প্রায় পুরোপুরি স্বাধীন। তাদের সব মসজিদ খুলে দেওয়া হয়েছে। তারা ধর্ম শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারেন। নতুন মসজিদ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, ইসলামি সাহিত্য প্রকাশ ও প্রচার করতে পারেন। রাশিয়া থেকেই ২০১৮ সালে প্রায় ২০ হাজার মুসলিম হজ পালন করেছেন। মেয়েদের শিক্ষা বাড়ছে এবং হিজাবের ব্যবহারও বাড়ছে। এসব দেশ থেকে ছাত্রছাত্রীরা মুসলিম বিশ্বে পড়তে যাচ্ছে এবং তারা ফিরে এসে কাজ করছে ইসলামের জন্য।
আমরা জানি, কোনো রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের ক্ষমতা নির্ধারিত হয় তার দেশের শক্তিমত্তা এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সেই ক্ষমতা চর্চার সক্ষমতার ওপর। এ দু’টি বিষয়ের সমন্বয় করলে পুতিনের ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের তালিকায় সবার ওপরে থাকার কারণ সহজেই স্পষ্ট হয়। পুতিন রাশিয়ায় ক্ষমতার এমন এক কাঠামো গড়ে তুলেছেন, যেখানে তিনিই সর্বেসর্বা। তাই ধর্ম নিয়ে পুতিনের দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করার সুযোগ নেই।
ব্যক্তিজীবনে পুতিন বেশ ধর্মানুরাগী। তিনি নিয়মিত গির্জায় যান। ধর্মীর মূল্যবোধ তার ভেতরে রয়েছে বলেই, তিনি সমাজ থেকে ধর্মকে বিচ্ছিন্ন করে বা দূরে সরিয়ে রাখতে চাইছেন না। তাই অন্যান্য ধর্মের মতো ইসলামকেও বরণ করেছেন তিনি। পুতিনের মতে, সব ধর্মের বন্ধন ও সহিষ্ণুতা ছড়িয়ে দিতে পারলে তা মানবজাতির কল্যাণ বয়ে আনবে। ধর্ম নিয়ে জোর-জবরদস্তি না করার ইসলামি শিক্ষা রাশিয়া নিচ্ছে।
রাশিয়ানদের গর্ব করার মতো অনেক কিছুই আছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় দেশ রাশিয়া। রাশিয়া ধনী দেশও বটে। তাদের তেল, গ্যাসসহ বেশ কিছু প্রাকৃতিক সম্পদের বড় ধরনের মজুদ আছে। সাংস্কৃতিকভাবেও দেশটি সমৃদ্ধ। হারতে হারতে বিশ্ব রাজনৈতিক মঞ্চে স্বরূপে ফিরে আসার উদাহরণ রাশিয়া।
এমতাবস্থায তারা যদি মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রেখে বিশ্ব রাজনীতির নেতৃত্ব বজায় রাখতে চায়, সেটা অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার দাবি রাখে। সে হিসেবে মুসলমানদের প্রতি পুতিনের দৃষ্টিভঙ্গি, মুসলমানদের প্রতি সৌহার্দ্য প্রদর্শন, সংলাপ, আলাপ-আলোচনা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা দেওয়াকে মুসলিম বিশ্বের নেতৃবৃন্দকে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবা উচিত; বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম নেতাদের। তবেই ইঙ্গ-মার্কিন-ইসরাইল বলয় থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।
আরেকটি কথা, পবিত্র কোরআন সম্পর্কে বেশি বেশি আলোচনা হওয়ায় মানুষ কোরআনের মর্মবাণী বোঝার দিকে ধীরে ধীরে মনোযোগী হচ্ছে। মানুষের অনুসন্ধানী মন সত্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে। তাই মুসলমানদের উচিৎ, কোরআনে কারিমের প্রকৃত শিক্ষা, রাসূলের আদর্শ প্রচারে আরও মনোযোগী হওয়া, খণ্ডিত ইসলামের অনুসরণ, প্রচার-প্রসার বন্ধে উদ্যোগী হওয়া।