পীর শব্দটি ফার্সি। আরবিতে বলা হয় মুরশিদ। মুরশিদ শব্দের অর্থ হলো- পথপ্রদর্শক। যিনি আল্লাহর আদেশ-নিষেধ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেন, মানুষকে জানান ও সতর্ক করেন।
মুরিদ শব্দটিও আরবি। অর্থ হলো- ইচ্ছাপোষণকারী। যে ব্যক্তি আল্লাহর আদেশ নিষেধ আল্লাহতায়ালা যেভাবে চান, সেভাবে পালন করার ইচ্ছাপোষণ করে কোনো বুজুর্গ ও আল্লাহওয়ালা ব্যক্তির হাত ধরে শপথ করেন- তিনি মুরিদ। এ ব্যাখ্যা থেকে এটা স্পষ্ট যে, পীর হবেন শরিয়তের আদেশ-নিষেধ পালন করার প্রশিক্ষণদাতা। আর প্রশিক্ষণ নিতে আসা শিক্ষার্থী হলেন- মুরিদ।
পীর-মুরিদির এ পদ্ধতি হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সময় থেকে চলে আসছে। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) সাহাবাদের আল্লাহমুখী হওয়ার প্রশিক্ষণ দিতেন। সাহাবারা হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিতেন।
বর্তমান জামানায় ফেতনার ছড়াছড়ি চলছে। এ অবস্থায় বিশুদ্ধ দ্বীনের ওপর থাকা ও সঠিক পথনির্দেশক পাওয়া কঠিন। ‘কছদুস সাবীল’ নামক কিতাবে হাকিমুল উম্মত হজরত আশরাফ আলী থানভি (রহ.) খাঁটি পীর চেনার ১০টি আলামত লিখেছেন। সেগুলো হলো- সুন্নতি লেবাস, কোরআন-হাদিসের পর্যাপ্ত জ্ঞান, আমলকারী, এখলাস থাকা, দুনিয়াবিমুখতা, উত্তম আখলাকধারী হওয়া, নামাজে মনোযোগী, চোখের হেফাজত, পর্দা করা ও কোরআন তেলাওয়াত করা।
সুতরাং কেউ আধ্যাত্মিক গুরু বা পীর ধরতে চাইলে হজরত আশরাফ আলী থানভি কর্তৃক রচিত ‘কছদুস সাবীল’ নামক কিতাবে উল্লিখিত গুণাবলি তালাশ করে নেবেন।
যে ব্যক্তি নিজেই শরিয়তের বিধান মানে না, নামাজ পড়ে না, পর্দা করে না, সতর ঢেকে রাখে না বা শরিয়তের আবশ্যকীয় কোনো বিধান পালন করে না- সে ব্যক্তি কিছুতেই পীর তথা মুরশিদ হতে পারে না। কারণ তার নিজের মাঝেই যখন শরিয়ত নেই, সে কিভাবে অন্যকে শরিয়তের ওপর আমল করার প্রশিক্ষণ তেবে? নিজেইতো প্রশিক্ষিত নয়।
ইসলামি স্কলাররা বলেছেন, সুন্নত ও শরিয়তের অনুসারী হক্কানি পীর হেদায়েতের পথ প্রদর্শক। কোনো পীর হেদায়েতদাতা নয়। এমনকি কোনো নবীও হেদায়েতের মালিক ছিলেন না। হেদায়েতদাতা একমাত্র আল্লাহতায়ালা। কল্যাণ-অকল্যাণের মালিকও একমাত্র আল্লাহতায়ালা। রিজিকদাতা, সন্তানদাতা, ব্যবসা-বাণিজ্যে উন্নতিদানকারী এবং মনোবাঞ্ছা পূরণকারী একমাত্র আল্লাহ। কোনো পীর, তিনি জীবিত হোন বা মৃত এসব কাজের ক্ষমতা রাখেন না।
অতএব, আল্লাহতায়ালা ব্যতীত কারও কাছে সন্তান চাওয়া, কাউকে লাভ-ক্ষতির মালিক মনে করা, আয়-উপার্জনে উন্নতিদানকারী মনে করা সম্পূর্ণ শিরক ও ঈমান পরিপন্থী আকিদা। কেউ যদি কখনও এমন কাজ করে থাকে তাহলে তাকে খাঁটি অন্তরে তওবা করে নতুনভাবে ঈমান আনয়ন করতে হবে এবং এগুলো যে একমাত্র আল্লাহতায়ালারই ক্ষমতা এ ব্যাপারে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে হবে।
আমাদের দেশে কোনো কোনো পীরের সামনে সিজদা করতে দেখা যায়। এটাও গোনাহের কাজ। সিজদা একমাত্র আল্লাহতায়ালার হক। কোনো মানুষকে বা কারও মাজারকে কিংবা অন্যকোনো মাখলুককে সিজদা করা সম্পূর্ণ হারাম। যদি ইবাদত-উপাসনার নিয়তে সিজদা করে তাহলে কাফের হয়ে যাবে। যদি আদব ও সম্মান প্রদর্শনের জন্য করে থাকে তাহলে শুধু এ কারণে সরাসরি কাফের না হলেও সে কুফুরির নিকটবর্তী হয়ে যায়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই কর্মের সঙ্গে এমন কিছু আকিদা-বিশ্বাস থাকে, যা তাকে ঈমান থেকে খারিজ করে দেয়। তাই এসব কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে, আগে করে থাকলে একনিষ্ঠভাবে তওবা-ইস্তিগফার করতে হবে।
কোনো পীরকে বিপদ-আপদ, দুঃখ-কষ্ট দূর করা ও কল্যাণ সাধনের ক্ষেত্রে পীর-বুজুর্গদের অনেক ক্ষমতা আছে মনে করা যাকে না। মৃত ও জীবিত পীরের নিকট প্রার্থনা কিংবা তাদের কাছে মুক্তি চাওয়া যাবে না।
কল্যাণ-অকল্যাণ, ভালো-মন্দ, উপকার-অপকার, দুঃখ-কষ্ট ইত্যাদির সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী একমাত্র আল্লাহতায়ালা। তিনি ব্যতীত অন্য কারও এ ধরনের কোনো ক্ষমতা নেই। এর ওপর ঈমান ও বিশ্বাস রাখা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অপরিহার্য। তাই বিপদ-আপদ, দুঃখ-কষ্ট, রোগ-শোক থেকে মুক্তি পাওয়া বা কল্যাণ-অকল্যাণে সাহায্য চাওয়ার ক্ষেত্রে মুমিনের কর্তব্য হলো, একমাত্র আল্লাহতায়ালার শরণাপন্ন হওয়া এবং তার কাছে সাহায্য চাওয়া। এগুলো আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও কাছে চাওয়া শিরক।
তবে যদি জীবিত কোনো হক্কানী পীর-বুজুর্গ কিংবা আল্লাহর প্রিয় বান্দার নিকট এ মর্মে দোয়া চাওয়া হয় যে, আপনি আল্লাহর কাছে দোয়া করেন, যেন আল্লাহতায়ালা আমাকে বিপদ-আপদ থেকে উদ্ধার করে দেন এবং এক্ষেত্রে দোয়া প্রার্থীর এ বিশ্বাস থাকে যে, তিনি আল্লাহর প্রিয় ও নৈকট্যভাজন বান্দা হিসেবে আশা করা যায়, আল্লাহতায়ালা তার দোয়া কবুল করবেন। তাহলে এতে কোনো সমস্যা নেই। বরং এটি হাদিস ও সাহাবিদের আমল দ্বারা প্রমাণিত।