কোরআনে কারিমের শুরুতে আল্লাহতায়ালা কোরআন সম্পর্কে মানবজাতিকে সচকিত করে ঘোষণা করেন, ‘এটি এমন এক কিতাব (বিধান), যার মধ্যে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি নেই।’ -সূরা বাকারা: ২
আল্লাহতায়ালার কিতাব কোরআনে কারিমে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন নেই, সংস্কার নেই। শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়তি জীবনের ২৩ বছরে কোরআন যেভাবে নাজিল হয়েছিল হুবহু ঠিক সেভাবেই সমগ্র দুনিয়াজুড়ে আজও কোরআন বিদ্যমান।
‘এ কিতাবে কোনোপ্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি নেই’ মানুষের লেখা যেকোনো গ্রন্থের শুরুতে এভাবে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়ার দুঃসাহস কোনো লেখক বা গ্রন্থপ্রণেতা করতে পারেন না। বরং প্রত্যেক গ্রন্থকারই বইয়ের শুরুতেই উল্লেখ করে দেন, ‘ভুলত্রুটি মার্জনীয়। কোনো পাঠকের নজরে কোনো ভুল পরিলক্ষিত হলে পরবর্তী সংস্করণে তা শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করবো।’ অর্থাৎ মানুষের কোনো কাজই ভুলচুকের ঊর্ধ্বে নয়। এটাই স্বাভাবিক।
পৃথিবীতে ১০-২০ পৃষ্ঠার কোনো একটি বইয়ের কোনো হাফেজ কি আছে? অর্থাৎ শুরু থেকে শেষ অবধি কোরআন ব্যতীত অন্যকোনো গ্রন্থ কেউ মুখস্থ করেছেন- বলে মনে হয় না। কারণ তা সম্ভব না। কিন্তু কোরআনে কারিমের প্রায় ৬ কোটিরও বেশি হাফেজ রয়েছে এক সমীক্ষায় জানা গেছে।
কোরআনের হাফেজ হওয়ার সংখ্যা তিন দিন বেড়েই চলছে। যারা এর জের, যবর, পেশ ও নোকতা অর্থাৎ বিন্দুবিসর্গ পর্যন্ত নিখুঁতভাবে কণ্ঠস্থ করেছেন।
লাখ লাখ শিশু পুরো কোরআন মুখস্থ করেন মাত্র ৩-৪ মাসে। আবার অসংখ্য অন্ধ হাফেজও রয়েছেন পৃথিবীতে। মুখস্থ করার হিসেবে কোরআন ব্যতীত এমন কোনো নজির আর পৃথিবীতে নেই। এটা আল্লাহর কালাম কোরআনে কারিমে অলৌকিকতার চেয়ে আর কী হতে পারে?
পৃথিবীর সমস্ত ছাপা কোরআন, ক্যাসেট ও হার্ডডিস্ক আগুনে পুড়ে ছাই করে ফেললেও এর কপি হাফেজদের কাছ থেকে সহজেই পাওয়া যাবে। অন্যকোনো গ্রন্থের এমনটি প্রায়ই অসম্ভব। কারণ মানবপ্রণীত কোনো গ্রন্থই হুবহু কারো মুখস্থ নেই।
উল্লেখ্য, প্রায় ১৪শ’ বছর আগের তুলির সাহায্যে লেখা আর বর্তমান কম্পিউটার যুগের কোরআনের মধ্যে বিন্দুমাত্র ফারাক নেই। এটাই একটি অলৌকিকতা।
এর কারণ হচ্ছে, কোরআন সর্বশেষ আসমানি কিতাব। এর সংরক্ষক আল্লাহতায়ালা নিজে। পবিত্র কোরআনের এমন অলৌকিক নজির আর কোথাও খুঁজে পাওয়া মুশকিল। পৃথিবীর বহু পন্ডিত পবিত্র কোরআনের খুঁত ধরতে এসে বিস্ময়ে-বিমুগ্ধ হয়ে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিচ্ছেন প্রতিদিন। ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে এর অসংখ্য নজির রয়েছে।
কোরআন নাজিলের সময়কালে একসময় আরবের কবিরা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বলেছিল, কোরআনের মতো তারাও নিখুঁত বাণী লেখতে সক্ষম। আল্লাহতায়ালা হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ওহির মাধ্যমে জানান, ঠিক আছে। ওরা লেখুক। কিন্তু আরবের সবকবি একসঙ্গে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বলতে বাধ্য হয়- এ হলো আসলেই মহান আল্লাহর বাণী।
পবিত্র কোরআন যে আল্লাহতায়ালার বাণী তা বহুভাবে বহুবার প্রমাণিত হয়েছে। পৃথিবীর কোনো পন্ডিত এতে সামান্যতম ভুল খুঁজে পাননি। পাবার উপায়ও নেই।
উল্লেখ্য, কোরআন শুধু মুসলিমদের নয়। এ কিতাব সমগ্র মানবজাতির এক মহাসম্পদ। এর আলোয় আলোকিত হবার অধিকার রয়েছে প্রত্যেক মানুষের। এ কিতাব শুধু মুসলিমরা পড়বে এমন নয়। জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও গোত্র নির্বিশেষে সবাই এ কিতাব নির্দ্বিধায়-নির্বিঘ্নে অধ্যয়ন করতে পারেন। পাঠ করতে পারেন। পারেন এর মর্ম উপলব্ধি করতে।
হেরাগুহায় বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধ্যানমগ্ন থাকা অবস্থায় প্রথম যে ওহি নাজিল হয়েছিল তা কী ছিল জানেন নিশ্চয়। ছিল- পড়ুন, আপনার রবের নামে যিনি আপনাকে সৃষ্টি করেছেন। এই যে ‘পড়ুন’,। এর তাৎপর্য হচ্ছে মানুষকে পড়তে হবে। অধ্যয়ন করতে হবে। বিদ্যার্জন ব্যতীত কল্যাণ যেমন নিজের জন্য সম্ভব নয়, তেমনই অন্যের জন্যও তা সম্ভব নয়। পড়া বা শিক্ষাই হচ্ছে উন্নয়ন ও সভ্যতার চাবিকাঠি। পড়া বা শিক্ষার মধ্যেই মানবতার প্রকৃত মুক্তি। তাই প্রথম ওহি বা কোরআনের প্রথম বাণীই হলো- ‘ইকরা’ বা পাঠ করুন।
অনেকে মনে করেন কোরআন কেবল মুসলিমদের জন্য। কোনো কোনো মুসলিমেরও এমন ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। আসলে তা ঠিক নয়। কোরআন সবমানুষের জন্য নাজিল হয়েছে। পৃথিবীর আলো-বাতাস, খাদ্য-পানীয়তে যেমন সমান অধিকার, তেমনই পবিত্র কোরআন আল্লাহর তরফ থেকে একটি বিশেষ রহমত ও নিয়ামত। সূর্যের আলো যেমন সবার জন্য উন্মুক্ত, তেমনই কোরআনের জ্ঞান অর্জনসহ এ থেকে সব মানুষই ফায়দা নিতে পারে। যারা এ চিরশাশ্বত নিয়ামত থেকে বঞ্চিত তারা সত্যিকার অর্থেই হতভাগ্য বৈকি।
হঠকারিতা নয়, বিদ্বেষে অন্ধ হয়ে নয়; কোনো ভাবাদর্শে আপ্লুত বা আবেগতাড়িত হয়ে নয়। গভীর আন্তরিকতা ও ঔদার্য নিয়ে এসব কথা ভাবুন। তাহলে অন্ধকারাচ্ছন্ন মনোজগতের দুয়ার খুলে যাবে সহসা।
সম্প্রতি বৃটিশ সংস্থা ‘ফেইথ ম্যাটার্স’র গবেষণা জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে, শুধু ব্রিটেনে গত ১০ বছরে ৪০ হাজারের অধিক তরুণ-তরুণী পবিত্র কালেমা পড়ে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছেন। আর তাদের মনের দুয়ার খুলতে সাহায্য করেছে কোরআন। আসলে কোরআনই পারে মানুষের অন্ধকারাচ্ছন্ন মনোজগতের দুয়ার খুলতে।