১৯৫৭ সালে জাপানের একটি বিখ্যাত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে পবিত্র কোরআনের জাপানি অনুবাদ প্রকাশিত হয়, যা জাপানি মুসলিম-অমুসলিম সবার মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে| অবশ্য ১৯২০, ১৯৩৭ ও ১৯৫০ সালে কোরআনের আরও তিনটি অনুবাদ জাপানি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছিল। এই চারটি অনুবাদই ছিল অমুসলিম পণ্ডিতদের দ্বারা এবং তা করা হয়েছিল ইংরেজি ভাষা থেকে। ফলে তাতে বেশ কিছু অসংগতি ও ত্রুটি থেকে যায়, যা হাজি ওমর মিতাকে ব্যথিত করে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন নিজেই জাপানি ভাষায় কোরআনের অনুবাদ করবেন।
১৯৬১ সালে ৭০ বছর বয়সী ওমর মিতা পাকিস্তানে যান। সেখানে বিশেষজ্ঞ আলেমদের সহযোগিতায় কোরআনের অনুবাদ শুরু করেন। পাকিস্তানি আলেমদের মাধ্যমে রাবেতা আল আলম আল ইসলামির সঙ্গে তার যোগাযোগ হয় এবং তারা তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। রাবেতার আমন্ত্রণে তিনি সৌদি আরব যান এবং আরব বিশ্বের খ্যাতিমান কোরআন গবেষকদের সহযোগিতায় অনুবাদের কাজ অব্যাহত রাখেন। কিন্তু সেখানে অবস্থানকালে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি মারাত্মক আহত হন এবং তার বিশেষ সহযোগী হাফেজ আবদুর রশিদ মারা যান। এভাবে নানা ঘাত-প্রতিঘাত শেষে ১৯৬৮ সালে অনুবাদ শেষ করেন ওমর মিতা।
এরপর জাপান মুসলিম অ্যাসোসিয়েশনের একটি কমিটি দেড় বছর ধরে তার অনুবাদকর্মটি যাচাই করে দেখে এবং প্রয়োজনীয় সংশোধন করে। ১৯৭০ সালে তা চূড়ান্ত নিরীক্ষা ও অনুমোদনের জন্য রাবেতা আল আলম আল ইসলামির উচ্চতর কমিটির কাছে পাঠানো হয়। ছয় মাস পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তারা ওমর মিতার অনুবাদ অনুমোদন এবং ছাপানোর সুপারিশ করে।
অনুমোদন পেয়ে তিনি জাপানের তাকুমি কোবো প্রিন্টিং কম্পানির হাতে তুলে দেন। হিরোশিমায় অবস্থিত এই কোম্পানির মালিক মুসলিম। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ১৯৭২ সালে প্রকাশিত হয় জাপানি ভাষায় আল কোরআনের সার্থক অনুবাদ।
বৃদ্ধ বয়সে স্বদেশি মানুষের জন্য তার এই ত্যাগ ও পরিশ্রম ছিল দৃষ্টান্তহীন, যা তাকে ইতিহাসে অমর করে রেখেছে। ১৯৮৩ সালের ২৯ মে হাজি ওমর মিতা ইন্তেকাল করেন।
হাজি ওমর মিতা ১৯ ডিসেম্বর ১৮৯২ সালে জাপানের ইয়ামাগুচি প্রিফেকচারের একটি অমুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পারিবারিক নাম ছিল রায়োইচি মিতা। ১৯১৬ সালের মার্চ মাসে ইয়ামাগুচি কমার্স কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন, যা বর্তমানে ইয়ামাগুচি ইউনিভার্সিটি।
শৈশবে শত্রু রাষ্ট হিসেবে প্রতিবেশী চীনের প্রচুর আলোচনা শোনেন ওমর মিতা। তা থেকেই চীনের ব্যাপারে ব্যাপক কৌতূহল তৈরি হয়। কৌতূহল মেটাতে চীন সফরে যান এবং সেখানেই ইসলাম ও মুসলিম সমাজের সঙ্গে পরিচিত হন। এমনকি ১৯২০ সালে জাপানের ‘তোয়া কেইজাই কেনক্যু’ নামের সাময়িকীতে তিনি ‘চীনে ইসলাম’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধও লেখেন। তত দিনে অবশ্য তুর্কি মিত্রদের সুবাদে জাপানিরা ইসলামের সঙ্গে পরিচিত হতে শুরু করেছে।
জাপানে ইসলাম প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন হাজি ওমর কোতারো ইয়ামাওকা। ১৯০৯ সালে প্রথম জাপানি হিসেবে তিনি হজ পালন করেন। তিনি নানাভাবে ইসলাম প্রচারে কাজ করেন। ১৯১২ সালে হাজি ওমর কোতারো ইয়ামাকোর হজ সফরসহ বেশ কিছু বই প্রকাশ পায়, যা পড়ে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত হন ২০ বছর বয়সী রায়োইচি মিতা।
১৯২১ সালে জাপানে আসেন রায়োইচি মিতা। ফিরেই হাজি ওমর কোতারোর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু তখনও তিনি ইসলাম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। এভাবেই কেটে আরও ২০ বছর। ১৯৪১ সালে রায়োইচি মিতা ইসলাম গ্রহণ করে ওমর মিতা নাম ধারণ করেন। অবশ্য তখন তিনি চীনেই অবস্থান করছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর তিনি স্থায়ীভাবে দেশে ফিরে আসেন। চীনা ভাষার শিক্ষক হিসেবে ওসাকার কানসাই ইউনিভার্সিটিতে যোগ দেন। কিছুদিনের মধ্যে স্ত্রী মারা যাওয়ায় তিনি সব ধরনের চাকরি থেকে অব্যাহতি নেন এবং ইসলামের সেবায় আত্মনিয়োগ করেন।
১৯৫২ সালে ওমর মিতা টোকিওতে চলে আসেন। ইসলাম প্রচারে নেমে আরবি ভাষায় নিজের দুর্বলতা অনুভব করে আরবি শেখার সিদ্ধান্ত নেন। এ সময় তার সঙ্গে পাকিস্তানের কিছু আলেম ও তাবলিগি সাথির সঙ্গে পরিচয় হয়, যারা তাকে আরবি ভাষা শিখতে সাহায্য করেন। ১৯৫৭ সালে তিনি তাবলিগের কাজে অংশ নিতে পাকিস্তান সফর করেন।
১৯৫৮ সালে তিনি পবিত্র হজ আদায় করেন। হজ পালন শেষে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং ইসলাম প্রচারে আরও বেশি মনোযোগ দেন। ১৯৬০ সালে তিনি জাপান মুসলিম অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এ সময় জাপানি ভাষায় তার বেশ কয়েকটি বই প্রকাশ পায়। তন্মধ্যে অন্যতম হলো- ‘ইসুরামু রিকাই নো তামেনি’ (ইসলাম অনুধাবন), ‘ইসুরামু ন্যুমোন’ (ইসলাম পরিচিতি), শায়খুল হাদিস জাকারিয়া রহ.-এর হেকায়েতে সাহাবার অনুবাদ ‘সাহাবা মনোগাতারি’ ইত্যাদি।
জাপানে মুসলমানের সংখ্যা কত তার সরকারি কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে এ সংখ্যা দেড় লাখের বেশি বলে ধারণা করা হয়। মুসলমানদের ১০ শতাংশই জাপানি বংশোদ্ভূত।
১৯৭০ সালের দিকে টোকিওতে মসজিদের সংখ্যা ছিল মাত্র দু’টি। এখন এখানে ২০০টি মসজিদ ও মুসাল্লা (অস্থায়ী নামাজঘর) আছে। জাপানে কবে ইসলামের আলো প্রবেশ করেছে সে ইতিহাস অনেকটাই অজানা।
ধারণা করা হয়, অষ্টম শতাব্দীতে জাপানে ইসলামের বাণী পৌঁছেছে। তবে মেইজি শাসনামলে (১৮৬৮-১৮৯০) জাপান যখন বিশ্বব্যাপী তাদের উপস্থিতির অংশ হিসেবে উসমানিয় সাম্রাজ্য এবং মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে বাণিজ্য ও তথ্যবিনিময় মিশন শুরু করে, তখন থেকেই তারা ইসলাম ও মুসলমানদের সংস্পর্শে আসতে শুরু করে। কারণ, মুসলমানদের ইতিহাস যেটুকু পাওয়া যায়, তা এ সময় থেকেই।
১৯৬৬ খিস্টাব্দে জাপানে ইন্টারন্যাশানাল ইসলামিক সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসলামিক সেন্টার ‘আস সালাম’ নামে একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকাও বের করে। এছাড়া সেন্টারের পক্ষ থেকে জাপানি শিশুদের প্রাথমিক ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা ও হজ গমনে ইচ্ছুকদের হজে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। এই সেন্টারকে কেন্দ্র করেই জাপানে দাওয়াতে তাবলিগের কাজ চলছে বেশ জোরালোভাবে।
এখন অবশ্য তাবলিগ জামাতের লোকেরা টোকিওর শহরতলী এলাকা সাইতামারে একটি ভবন কিনে সেখানে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছেন। বর্তমানে সেটাই তাবলিগের মারকাজ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
জাপানের বর্তমান মুসলমান প্রজন্ম জাপানে ইসলামের প্রচার ও প্রসারের বেশ আন্তরিক। নানা প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে তারা কাজ করে যাচ্ছে আপন গতিতে। তাদের প্রত্যাশা অচিরেই জাপানে অন্যান্য দেশের মতো ইসলাম জনপ্রিয় ও প্রভাব বিস্তারকারী ধর্মে পরিণত হবে। বাড়বে মসজিদের সংখ্যা। যে মসজিদের মিনার থেকে ভেসে আসবে আজানের সুর।