‘আমাদের দেশে অনেকাংশে ডিভোর্সের (তালাক) সংখ্যা বেড়ে গেছে। তবে ডিভোর্সের মধ্যে শিক্ষিত লোকের সংখ্যাই বেশি। সাধারণ মানুষের মধ্যে এই প্রবণতাটা কম।’ একটি জামিন আবেদনের শুনানিকালে এমন মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট। সম্প্রতি বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম এবং বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের ডিভিশন বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন।
একটি ধর্ষণ মামলায় আসামির পক্ষে জামিন শুনানির একপর্যায়ে আদালত আরও বলেন, ‘আমরা তো নানাভাবে সমালোচিত হচ্ছি। আসলে ব্যক্তিগতভাবে দুই-একটি পত্রিকার রিপোর্ট দেখে খুব অফেন্ডেড (অপরাধবোধ) হয়েছি। যেখানে লেখা হয়েছে, ‘ধর্ষকের সঙ্গে ধর্ষিতার বিয়ে’ এভাবে তো রিপোর্ট হওয়া উচিত না। আবার নারীবাদী সংগঠনগুলো বলছে এ ধরনের বিয়েতে ধর্ষকরা উৎসাহিত হবে।’ ‘যে যাই সমালোচনা করুক, আমরা এটাকে উৎসাহিত করব’ এমনটি উল্লেখ করে বিচারক বলেন, ‘প্রযুক্তির কারণে এখন সমাজে মানুষের সম্পর্ক গড়তেও সময় লাগে না, ভাঙতেও সময় লাগে না। দেখবেন আমাদের দেশে ডিভোর্সের সংখ্যা অনেকাংশে বেড়ে গেছে। শিক্ষিত লোকদের মধ্যে বেশি হচ্ছে বরং সাধারণ মানুষের মধ্যে এই প্রবণতাটা কম।’
বেশ কিছুদিন আগে সহযোগী এক গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘গত এক দশকে দেশে তালাকের ধরণ বদলে গেছে। আগে ৭০ শতাংশ তালাকের ঘটনা ঘটতো স্বামী কর্তৃক। এখন তালাকের ঘটনায় নারীরা পুরুষের চেয়ে দশগুণ এগিয়ে গেছে। বর্তমান সময়ে ৮০ শতাংশ তালাকের ঘটনা ঘটছে স্ত্রী কর্তৃক।’
ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘ঢাকা সিটি কর্পোরেশন দক্ষিণ ও উত্তরের তথ্যানুযায়ী, ২০১০-২০১৯ সাল পর্যন্ত রাজধানীতে তালাকের সংখ্যা প্রায় সত্তর হাজার। প্রতিদিন গড়ে ৫০ থেকে ৬০টির মতো বিচ্ছেদের আবেদন জমা হচ্ছে।’
এটা শুধু ঢাকার দুই সিটির সংখ্যা। সারাদেশে অবস্থা কত ভয়াবহ তা সহজেই অনুমান করা সম্ভব। একজন মুফতি হিসেবে অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, দেশজুড়ে তালাক প্রবণতা ক্রমবর্ধমান, যা একটি সমাজের জন্য, বিশেষত মুসলিম সমাজের জন্য খুবই দুঃখজনক ও আশঙ্কাজনক। কারণ, বিবাহ-বিচ্ছেদের কুফল অনেক দূর পর্যন্ত গড়ায়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমান সমাজে বিচ্ছেদ প্রবণতার এই ক্রমবর্ধমান বিস্তার কেন। সমাজবিজ্ঞানীরা নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নানা কারণ বর্ণনা করেছেন। তবে যে কথাটি প্রায় সবাই বলছেন তা হচ্ছে, ধর্মীয় অনুশাসনের অভাব। বাস্তবেই এটা অনেক বড় কারণ।
ধর্মীয় অনুশাসনের বিষয়টি অনেক বিস্তৃত। বিশ্বাস ও মূল্যবোধ, জীবন-দর্শন ও জীবনধারা, স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক, একে অপরের হক সম্পর্কে সচেতনতা, বিনয় ও ছাড়ের মানসিকতা- এ সবই ধর্মীয় অনুশাসনের অন্তর্ভুক্ত। এরপর পর্দা রক্ষা, পরপুরুষ কিংবা পরনারীর সঙ্গে সম্পর্ক ও মেলামেশা থেকে বিরত থাকা ইত্যাদিও বিশেষ ধর্মীয় অনুশাসন। যা পালন না করাও স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের অবনতি ও বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ। পরিসংখ্যান ও হাইকোর্টের মন্তব্য বিষয়টিকে সমর্থন করে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তাদের গবেষণা-পরিসংখ্যান বলছে, বিচ্ছেদের যেসব আবেদন ইতোমধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে তার মধ্যে ৮৭ শতাংশ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে পরকীয়ার জের ধরে। কোনো ক্ষেত্রে স্বামীর পরকীয়া, কোনো ক্ষেত্রে স্ত্রীর।
কাজেই সমাজবিজ্ঞানীদের কর্তব্য, এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা। কেন এই সমাজে পরকীয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এর প্রতিকারের উপায় কী- তা নিয়ে নির্মোহ চিন্তা-ভাবনার এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন।
পরিসংখ্যানের আরেকটি দিক হচ্ছে, বিবাহ বিচ্ছেদে পুরুষের চেয়ে নারীরা এগিয়ে। এক জরিপে দেখা গেছে, ৭০.৮৫ ভাগ তালাক গ্রহণ করছেন নারী আর ২৯.১৫ ভাগ তালাক দিচ্ছেন পুরুষ।
এর কারণ হয়তো অনেক ক্ষেত্রে এই যে, সাধারণত নারীরা নির্যাতিত হওয়ায় তারাই বিচ্ছেদের পদক্ষেপ বেশি নিচ্ছেন। তবে এর সঙ্গে অনেকেই আরও যা বলছেন তা হচ্ছে, মেয়েরা এখন অনেক অধিকার পেয়েছেন। সামাজিক ও অর্থনৈতিক দুই দিক থেকেই বেশি অধিকার পেয়ে স্বামীকে তালাক দিতে আগের চেয়ে বেশি আগ্রহী হচ্ছেন। আগেকার দিনের মায়েরা সংসার ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকতেন। এখন একক পরিবার হওয়ায় এবং বাইরে চাকরি-বাকরির ও সার্বিক স্বাধীনতার বিস্তার ঘটায় বাইরের মানুষের সঙ্গে তাদের মেলামেশা বেড়েছে এবং স্বামীদের চেয়ে বাইরের বন্ধু-বান্ধবদের দিকে বেশি ঝুকছে। তাই পারিবারিক অবস্থা একটু খারাপ হলেই তালাকের চিন্তা করছে। অনেক ক্ষেত্রে পুরুষরা খুব বেশি অত্যাচারী হয়ে থাকে। এছাড়া তথ্য-প্রযুক্তির প্রভাব, সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যম ও আধুনিক সংস্কৃতির কারণে সংসার ভাঙছে।
পারিবারিক শান্তির জন্য শুধু পরিবারকেন্দ্রিক ইসলামি অনুশাসনগুলোই নয়, সাধারণ অনুশাসনগুলো মেনে চলারও গুরুত্ব রয়েছে।
এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার। সেটা হলো, ইসলামি শরিয়তে অতীব প্রয়োজনের ক্ষেত্রে তালাকের অবকাশ রয়েছে, কিন্তু বিষয়টি পছন্দনীয় নয়। সুনানে ইবনে মাজাহ হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই বাণী বর্ণিত হয়েছে যে, ‘আল্লাহর কাছে সবচেয়ে অপ্রিয় হালাল হচ্ছে তালাক।’ -সুনানে ইবনে মাজাহ: ২০১৮
সুনানে আবু দাউদে মুহারিব ইবনে দিছার (রা.)-এর সূত্রে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইরশাদ বর্ণিত হয়েছে, ‘আল্লাহতায়ালা তার কাছে তালাকের চেয়ে অপ্রিয় কোনো কিছু হালাল করেননি।’ -সুনানে আবু দাউদ: ২১৭৭
কাজেই তালাকের ব্যাপারে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। নারী-পুরুষ উভয়ের কর্তব্য তালাক থেকে দূরে থাকা। তালাক দেওয়ার ক্ষমতা যেহেতু পুরুষের তাই পুরুষকে এই ক্ষমতা প্রয়োগের ব্যাপারে খুবই সংযমী হতে হবে। অন্যদিকে নারীর ব্যাপারে হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, ‘যে নারী তার স্বামীর কাছে বিনাকারণে তালাক প্রার্থনা করে তার জন্য জান্নাতের সুঘ্রাণ পর্যন্ত হারাম।’ -সুনানে ইবনে মাজাহ: ২০৫৫
সম্প্রতি পরকীয়ার যে বিস্তার এতে যেমন পুরুষের অপরাধ আছে তেমনি আছে নারীরও। দেখা যাচ্ছে যে, এক নারীর দ্বারা অন্য নারীর সংসার ভাঙছে। এক্ষেত্রে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই বাণী খুবই প্রাসঙ্গিক। জামে তিরমিজিতে হজরত আবু হুরায়রা (রা.)-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কোনো নারী যেন তার বোনের (অপর নারীর) হিস্যা নিজের পাত্রে উপুড় করে নেওয়ার জন্য তালাকের ফরমায়েশ না করে।’ -জামে তিরমিজি: ১১৯০
প্রত্যেকের কর্তব্য, নিজের পাতে যা আছে তাতেই সন্তুষ্ট থাকা। অন্যের পাতে যা আছে তাও নিজের পাতে নিয়ে নেওয়ার মতো লোভী মানসিকতা কোনো ভদ্র মানুষের হতে পারে না। উপরন্তু যখন ওই নারীটিও একজন নারী, একজন মুসলিম, দ্বীনী বোন।
এ সকল ঈমানি ও মানবীয় চেতনার বিস্তার এখন খুবই জরুরি। তাহলে অন্যায় অযৌক্তিক কারণে বিবাহ-বিচ্ছেদের হার অনেক হ্রাস পাবে। নারী-পুরুষ উভয়ে যদি পর্দার বিধান মেনে চলে তবে পরকীয়া জাতীয় কিছু ঘটার কোনো আশংকা থাকবে না। যারা শরিয়তের এ গুরুত্বপূর্ণ বিধানটি নিয়ে কটাক্ষ করে অথবা একে জটিল মনে করে তা পালনে বিরত থাকে, তাদের বিষয়টি ভাবা উচিত।
আমরা মুসলিম নর-নারীদের অনুরোধ করব, তারা যেন তালাকের আগে অন্ততঃ দশবার ভেবে নেন। শালিশ-সমঝোতাসহ যাবতীয় পূর্ব-পদক্ষেপ বিফল হয়ে গেলে যদি তালাকের পথে যেতেই হয় তবে কোনো নির্ভরযোগ্য আলেমের পরামর্শ নিয়ে তা করবে এবং কোনোক্রমেই এক তালাকে বায়েনের বেশি দেবে না; যেন পরে সংসার পুনর্বহালের সুযোগ থাকে।
পারিবারিক মর্যাদা, মূল্যবোধ, সন্তানের ভবিষ্যৎ এবং নিজেদের দ্বীন ও ঈমানের হেফাজতের জন্য তালাকের বিষয়ে সংযমী হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। মসজিদের সম্মানিত খতিব, ওয়ায়েজ এবং সমাজের নেতৃস্থানীয় বিজ্ঞ লোকজন গণমানুষকে এসব বিষয়ে বোঝাতে এগিয়ে আসলে তা অধিক কার্যকরি হবে বলে আশা করা যায়।