বিশ্বজুড়ে এখনও করোনার দাপট অব্যাহত। খোঁজ মিলেছে নতুন স্ট্রেনের। বিভিন্ন দেশ টিকাও আবিষ্কার করেছে। অনেক দেশ ইতোমধ্যে করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়া শুরু করেছে। এরই মধ্যে বিতর্ক শুরু হয়েছে করোনার টিকা হালাল-হারাম নিয়ে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বিভিন্ন দেশ তো বটেই, ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মুসলিমরাও এ প্রসঙ্গ নিয়ে জড়িয়েছেন বিতর্কে। কোনো কোনো মুসলিম স্কলার মুসলমানদের করোনার টিকা না নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তাদের যুক্তি, কোভিড-১৯ টিকা হারাম, কারণ করোনার ভ্যাকসিনে ইসলাম সমর্থন করে না- এমন উপাদানের সংমিশ্রণ রয়েছে।
টিকার সাধারণ একটি উপাদান জিলেটিন। সাধারণত মজুদ ও সরবরাহ সুবিধার জন্য স্ট্যাবিলাইজার হিসেবে অনেক টিকায় শূকরের চর্বিজাত জিলেটিন ব্যবহার করা হয়। তাই প্রশ্ন উঠেছে, শূকরের জিলেটিন কোভিডের টিকায় ব্যবহার করা হলে তা মুসলমানরা ব্যবহার করতে পারবে কিনা? কারণ ইসলামি আইন অনুযায়ী শূকর এবং তা থেকে তৈরি পণ্য হারাম। এছাড়া মুসলমানদের আশঙ্কার আরেকটি জায়গা হলো, জিলেটিন শূকরের চর্বি থেকে ব্যবহার না হলেও সঠিকভাবে জবাই না করা অন্যকোনো পশু, যেমন গরুর চর্বি থেকেও তৈরি হতে পারে।
যদিও বায়োটেকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তাদের টিকায় শূকরজাত কোনো উপাদান নেই। তবুও থেমে নেই বিতর্ক।
এমন পরিস্থিতিতে ‘টিকা হারাম’ দাবি করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ধরনের প্রচারণার ফলে ব্রিটেনের মুসলমানদের মধ্যে টিকা নেওয়ার বিষয়ে অনাগ্রহ দেখা দিতে পারে- এমন আশঙ্কাও দেখা দেয়। ফলে বিতর্ক শুরুর কয়েকদিনের মাথায় ব্রিটিশ ইসলামিক মেডিক্যাল এসোসিয়েশন (বিআইএমএ) এ বিষয়ে একটি বিবৃতি প্রকাশ করে।
বিবৃতিতে বিআইএমএ জানায়, করোনার ভ্যাকসিন বিষয়ে সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ, ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান এবং সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে তারা কথা বলেছেন। তারা জানিয়েছেন, ‘এই টিকা তৈরিতে কোনো পশুজাত দ্রব্য বা কোষ ব্যবহার করা হয়নি।’
সবশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ব্রিটেনের কয়েকজন মুফতি তাদের ফতোয়ায় বায়োটেকের টিকাকে ‘হালাল’ বলে ঘোষণা দেন। তাতেও বিতর্ক থামেনি।
এরই মধ্যে সৌদি আরবসহ বেশ কিছু মুসলিম রাষ্ট্রে বায়োটেকের টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে। সৌদি আরবের যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান থেকে শুরু করে দেশটির গ্র্যান্ড মুফতি শায়খ ড. আবদুল আজিজ বিন আবদুল্লাহ আলে শায়খ এই ভ্যাকসিন গ্রহণ করেছেন।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ইন্দোনেশিয়ায় ভ্যাকসিন নিয়ে বিতর্ক শুরু হলে চীনা কোম্পানি সিনোভ্যাক ইন্দোনেশিয়ার সরকারকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, করোনাভাইরাসের যে টিকা তারা বানিয়েছে; তাতে ‘শূকরের শরীরের কোনো উপাদান ব্যবহার করা হয়নি।’ তবে এক বাক্যের ওই বিবৃতিতে ইন্দোনেশিয়ার ধর্মীয় নেতারা সন্তুষ্ট হননি। তারা সিনোভ্যাকের কাছে টিকা উৎপাদনের বিস্তারিত তথ্য চান। কারণ শূকরের শরীরের সামান্যতম উপাদানও যদি থাকে, সেই টিকা আর ‘হালাল’ থাকবে না, তাতে অনেক মুসলমান টিকা নিতে আগ্রহী হবেন না। শেষ পর্যন্ত সিনোভ্যাক বিস্তারিত তথ্য দিয়েছে।
টিকার হালাল-হারাম বিতর্কের মাঝেই সংযুক্ত আরব আমিরাতের সর্বোচ্চ ইসলামি কর্তৃপক্ষ ঘোষণা (ফতোয়া) দিয়েছে, করোনার ভ্যাকসিনে শূকরের জিলেটিন থাকলেও তা মুসলমানরা গ্রহণ করতে পারবে। কাউন্সিলের চেয়ারম্যান শেখ আবদুল্লাহ বিন বাইয়াজ বলেন, ‘যদি বিকল্প না থাকে তাহলে শূকরের কারণে করোনার টিকা গ্রহণ হারাম হবে না। কারণ, মানুষের জীবন রক্ষা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।’
মুসলমানদের আশঙ্কার জায়গা হলো, ভ্যাকসিন সংরক্ষণের স্বার্থে বিভিন্ন পশুর জিলেটিন বিশেষ করে শূকরের জিলেটিন ব্যবহার করার সম্ভাবনা প্রবল। যদিও এখন পর্যন্ত অনুমোদিত ফাইজারসহ বিভিন্ন কোম্পানির উৎপাদিত ভ্যাকসিনে শূকরের জিলেটিন ব্যবহার কিংবা প্রয়োগের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে অদূর ভবিষ্যতে ভ্যাকসিনকে আরও সহজলভ্য করতে বিভিন্ন কোম্পানি শূকরের জেলিটিন ব্যবহার করতে পারে- এই সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, একজন মুসলিম হিসেবে কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিনে শূকরের জিলেটিন থাকলে সেটা ব্যবহার করা যাবে কিনা?
এ প্রশ্নের উত্তরের শুরুতে যে কথাটি বলা আবশ্যক তাহলো, ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে শূকর মূলগতভাবে নাপাক। শূকরের সবকিছুই নাপাক। শূকর খাওয়া কিংবা এর কোনো অংশকে ব্যবহার করা ইসলামি শরিয়ত অনুমোদন করে না, এটা হারাম ও নিষিদ্ধ। আর ইসলামি শরিয়ত যেসব বিষয়কে হারাম বলে ঘোষণা দিয়েছে, সেসব বিষয়কে ‘স্বাভাবিক’ অবস্থায় ওষুধ কিংবা পথ্য হিসেবে ব্যবহার করা হারাম।
তবে কোনো রোগের হালাল কোনো ওষুধ কিংবা প্রতিষেধক যদি না পাওয়া যায়, তাহলে সেক্ষেত্রে ‘বাধ্য হয়ে জীবন বাঁচানোর তাগিদে’ তা ব্যবহার করার পক্ষে জায়েজ বলে অনেক ইসলামি স্কলার মত দিয়েছেন। ফতোয়ায়ে আলমগীরীতে ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.)-এর বরাতে এ সংক্রান্ত ফতোয়া রয়েছে। এর পক্ষে মত দিয়েছেন ইমাম নববী ও ইবনে তাইমিয়াসহ অসংখ্য হাদিস বিশারদ।
এ মতের পক্ষের আলেমরা দলিল হিসেবে সূরা আনআমের একটি আয়াত উল্লেখ করেন। যে আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ তোমাদের জন্য যেসব জন্তু হারাম করেছেন, সেগুলোর বিশদ বিবরণ দিয়েছেন; কিন্তু সেগুলোও তোমাদের জন্য হালাল, যখন তোমরা নিরুপায় হয়ে যাও।’ এই আয়াতের আলোকে বলা যায়, জরুরি প্রয়োজনে জীবন বাঁচানোর জন্য হারাম বস্তু খাওয়ার অনুমতি ইসলামে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং কোনো রোগের ওষুধ কিংবা প্রতিষেধক হালাল বস্তু থেকে উৎপাদনের আগ পর্যন্ত জীবন রক্ষার তাগিদে হারাম বস্তুর সংমিশ্রণ কিংবা হারাম বস্তু দ্বারা উৎপাদন করা হলেও তা জায়েজ রয়েছে।
তবে অন্য আরেকদল মুফতিদের মতে, নিরুপায় অবস্থার সঙ্গে ভ্যাকসিন গ্রহণের বিষয়টি মেলালে চলবে না। কারণ, জীবন বাঁচানোর ক্ষেত্রে শেষ অবলম্বন হিসেবে হারাম বস্তু গ্রহণের বৈধতা থাকলেও যেকোনো ভ্যাকসিন গ্রহণ জীবন বাঁচানোর ক্ষেত্রে শেষ অবলম্বন নয়। সাধারণত ভ্যাকসিন দেওয়া হয়, প্রতিষেধক হিসেবে সুস্থ মানুষকে। নিশ্চিত মরণাপন্ন মানুষকে বাঁচানোর জন্য ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে না। সুতরাং ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে নিরুপায় বিশেষণ প্রয়োগ গ্রহণযোগ্য নয়।
আরেকটি কথা, বিভিন্ন টিকায় শূকরের জিলেটিন ব্যবহারের বিষয়ে মুসলমানদের আপত্তির কারণে সুইস প্রতিষ্ঠান নোভার্টিসের মতো অনেক কোম্পানি এখন বিকল্প জিলেটিনের দিকে ঝুঁকছেন। আর জিলেটিন যেহেতু বিভিন্ন হালাল পশু থেকে উৎপাদন সম্ভব, সেহেতু সুযোগ থাকা সত্ত্বেও শূকরের জিলেটিন সম্বলিত টিকা পরিহার করা মসুলমাদের কর্তব্য। এ লক্ষে সৌদি আরব এবং মালয়েশিয়াভিত্তিক এজে ফার্মা নিজেরাই হালাল টিকা তৈরির কাজ শুরু করেছে। করোনার ভ্যাকসিন উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোর এ বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়া আবশ্যক।