মোগল বাদশাহ আলমগীরের নাম প্রায় সবারই জানা। বাদশাহ হয়েও তিনি অতি সাধারণভাবে জীবন কাটাতেন। তিনি যখন ইন্তেকাল করেন, তখন টুপি সেলাই ও কোরআনে কারিম হাতে লিখে উপার্জন করা ৮০৫ রুপি সঞ্চয় রেখে যান। তন্মধ্যে চার রুপি আট আনা ব্যয় হয় তার কাফন-দাফনে, অসিয়ত মোতাবেক অবশিষ্ট অর্থ দান করে দেওয়া হয়।
ষষ্ঠ মোগল সম্রাট আবুল মুজাফফর মুহিউদ্দিন মুহাম্মদ আওরঙ্গজেব বাহাদুর আলমগীর। বাদশাহ আলমগীর নামেই বেশি পরিচিত। তিনি কোরআনে কারিমের হাফেজ ছিলেন। একাধারে ৪৯ বছর সাম্রাজ্য পরিচালনা করেছেন। নিজ প্রয়োজনে সাম্রাজ্যের সম্পদ ব্যয় করতেন না। নিজেই নিজের খরচ বহন করতেন। বাদশাহ হয়েও তিনি শুধু জীবিকা নির্বাহের নিমিত্তে, সংসারের অতিরিক্ত খরচ বহনের জন্য নিজ হাতে কোরআনে কারিম লিখেছেন, টুপি সেলাই করতেন।
জীবদ্দশায় বাদশাহ আলমগীর কোরআনে কারিমের ১৫টি কপি নিজ হাতে লিখেছেন। বাদশাহর হাতে লিখিত কোরআনে কারিমের একটি কপি ভারতের তেলেঙ্গানা রাজ্যের হায়দরাবাদের স্টেট মিউজিয়াম পাবলিক গার্ডেনে সংরক্ষিত আছে। বাংলাদেশেও তার লিখিত কোরআনে কারিমের দু’টি কপি রয়েছে।
কোরআনে কারিমের একটি কপি বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন সাহিত্য প্রতিষ্ঠান সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদে সংরক্ষিত। দুর্লভ কোরআন শরিফটি দেখতে প্রতিদিন দেশি-বিদেশি বিপুলসংখ্যক দর্শনার্থী মুসলিম সাহিত্য সংসদে আসেন।
কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ সূত্রে জানা যায়, সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার হেমু গ্রামের বিশিষ্ট দানবীর ও ব্যবসায়ী মৌলভি খান সাহেব আবদুল করিম এ কোরআন শরিফটি মুসলিম সাহিত্য সংসদে দান করেছেন।
কোরআন শরিফটি সংগ্রহে রয়েছে চমকপ্রদ এক ঘটনা। মৌলভি খান সাহেব আবদুল করিম মুম্বাই শহরে আগর-আতরের ব্যবসা করতেন। সে সময় মৌলভি সাহেবের সঙ্গে পরিচয় হয় এক নেপালি ব্যবসায়ীর। ওই নেপালির সংগ্রহে ছিল মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের হাতে লেখা একটি কোরআন শরিফ। নেপালি দুর্লভ এ পবিত্র গ্রন্থটি কাশ্মির থেকে সংগ্রহ করেছিলেন।
মৌলভি খান সাহেব আবদুল করিম মোগল সৈন্যদের যুদ্ধ পোশাক ও ঢালের বিনিময়ে নেপালি ব্যাবসায়ীর কাছ থেকে ওই কোরআন শরিফটি ১৯৪৬ সালে সংগ্রহ করেন। পরে তিনি কোরআন শরিফটি নিজ বাড়ি সিলেটের জৈন্তাপুরের হেমু গ্রামে নিয়ে আসেন। মৌলভি খান সাহেব আবদুল করিম কোরআন শরিফটি নিয়মিত তেলাওয়াত করতেন। পরে তিনি ১৯৪৯ সালে সংরক্ষণের প্রয়োজনে দুর্লভ কোরআন শরিফটি সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের তৎকালীন সম্পাদক নুরুল হকের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদে দান করেন। সেই থেকে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের হাতে লেখা কোরআন শরিফটি কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদে সংরক্ষিত আছে।
সাহিত্য সংসদের পড়ার কক্ষে কাচঘেরা একটি সুদৃশ্য বাক্সে বর্তমানে দুর্লভ পবিত্র ধর্মগ্রন্থটি রয়েছে। সম্রাটের হাতে লেখা এ পবিত্র গ্রন্থে রয়েছে চমৎকার নকশা আঁকা। কোরআনে কারিমের ওই কপিতে বাদশাহ সংক্ষিপ্তভাবে প্রতিটি আয়াতের তফসির করেছেন।
অন্যদিকে নাটোরের চলনবিল জাদুঘরেও রয়েছে মোগল সম্রাট আলমগীরের হাতে লেখা কোরআন শরিফের একটি কপি। চলনবিল জাদুঘরটি এলাকাবাসীর সহযোগিতায় ১৯৭৮ সালে গুরুদাসপুর উপজেলার খুবজীপুর গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন প্রফেসর আব্দুল হামিদ।
বাদশাহ আলমগীর খোদাভীরুতা এবং দূরদর্শিতার কারণে সাধারণ গণমানুষের কাছে ‘জিন্দা পীর’ হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। তার অনবদ্য রচনা ‘ফতোয়ায়ে আলমগীরী’ এখন পর্যন্ত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহে অনেক যত্নসহকারে পড়ানো হয়। এটিকে শরিয়া আইন এবং ইসলামি অর্থনীতির অন্যতম দলিল হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
উল্লেখ্য, বাদশাহ আলমগীর হায়দরাবাদের ৭ম নিজাম মীর উসমান আলী খান বাহাদুর স্টেট জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ভারতে মুসলিম ঐতিহ্যের শহর আওরঙ্গবাদ শহরও তার নামেই নামকরণ করা হয়।
সম্প্রতি বিজেপি রাজ্য সভাপতি আওরঙ্গবাদ শহরের নাম পরিবর্তনের অভিমত ব্যক্ত করেছে। হিন্দুত্ববাদী সংগঠন শিবসেনা ও বিজেপি আওরঙ্গবাদের নাম পরিবর্তন করে শম্ভুজিনগর রাখার ঘোষণা দিয়েছে।