৩,১২,৬৭৯ বর্গকিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট পোল্যান্ড ইউরোপের নবম বৃহত্তম দেশ। দেশটিতে মুসলমানদের সংখ্যা একেবারে কম। চার কোটি জনঅধ্যুষিত পোল্যান্ডে মুসলমানদের সংখ্যা মাত্র ৫০ হাজার। তন্মধ্যে তাতার ও বিদেশি অভিবাসীর সংখ্যা বেশি।
আমার কথা হলো দেশটিতে মুসলমানের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তাতার জনগোষ্ঠী আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অনুসারী। মিসর, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, আলজেরিয়া, ইরাক, তিউনিসিয়া, বসনিয়া-হার্জেগোভিনা, সোমালিয়া, চেচনিয়া, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে মুসলমানরা রাজনৈতিক বিপর্যয়ের ফলে দেশত্যাগ, উচ্চতর শিক্ষা, উন্নত জীবনের প্রত্যাশ, ব্যবসায়-বাণিজ্য প্রভৃতি কারণে পোল্যান্ডের বিভিন্ন শহরে আসতে থাকেন। এ দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টান এবং ইসলাম সম্পর্কে তাদের ধারণা অস্পষ্ট।
২০১৮ সালে ডানপন্থী কট্টর ক্যাথলিসিজম ও সেক্যুলার লিডার ক্যাম্প পোল্যান্ডে কথিত ‘ইসলামোফোবিয়া’ ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের প্রচেষ্টা চালায়। ২০১০ সালে রাজধানী ওয়ারশর অচোটা জেলায় একটি মসজিদ নির্মাণ করতে গেলে উগ্র জাতীয়তাবাদীরা বিরোধিতা ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এতদসত্ত্বেও মুসলমানরা মসজিদ নির্মাণ সম্পন্ন করেন। প্রথম প্রথম মুসলিম নারীরা হিজাব পরে চলাফেরা করতে কিছুটা বিড়ম্বনার শিকার হলেও ধীরে ধীরে পরিস্থিতি উন্নতি হচ্ছে।
বিগত সাত শ’ বছর ধরে মুসলমানরা পোল্যান্ডের জনগণ ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে আসছেন। ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের সঙ্গে ইসলামের অনুসারীদের বাহ্যত কোনো বিবাদ নেই। চতুর্দশ শতাব্দীতে গ্র্যান্ড ডিউক উইহোল্ডের শাসনামলে তাতাররা পোল্যান্ডে থাকার অনুমতি পান এবং সামরিক বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হন। ১৯৩৯ সালে পোল্যান্ডের অখণ্ডতা রক্ষার্থে মুসলমানরা জার্মানি ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেন। জোসেফ বেন (ইউসুফ পাশা) নামক এক জেনারেল পোলিশ সেনাবাহিনীর অধীনে আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিয়ে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। ওয়ারশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামতত্ত্ববিদ আগাটা নালবোরচিক জানান, সাতশ’ বছর আগে ইসলাম ধর্মাবলম্বী তাতার জাতিগোষ্ঠীর মানুষ এশিয়া, বিশেষ করে তুরস্ক থেকে পোল্যান্ডে এসেছিলেন। তুরস্কের বিরুদ্ধে জয়ী হতে পোল্যান্ডের রাজা ইওহানেস সোবিস্কিকে সাহায্য করেছিলেন যুদ্ধে পারদর্শী মুসলিম তাতাররা। রাজা তাদের প্রতি ছিলেন সহানুভূতিপ্রবণ এবং তাদের দেখভালের দিকে লক্ষ রেখেছিলেন। সেই থেকে তারা সেখানে বসবাস করতে শুরু করেন।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাতাররা পোল্যান্ডের সমাজে মিশে যান। তারা নিজেদের ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন। তারা পোলিশ ভাষায় কথা বলেন। কিন্তু নিজেদের ধর্ম তারা হারাননি। তখন থেকে মুসলিম তাতাররা প্রতিবেশী ক্যাথলিকদের সঙ্গে শান্তিতে বসবাস করছেন। ১৯৩৬ সালে ইসলাম ধর্মকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং স্কুলে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে পড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়। শিক্ষার্থীরা আরবি ভাষা শেখারও সুযোগ পায় (রায়হানা বেগম, ডয়চে ভেলে, ৩০ ডিসেম্বর-২০০৯)।
আন্তঃধর্মীয় সংলাপ
১২ বছর আগে ক্যাথলিক ও মুসলমানরা আন্তঃধর্মীয় সংলাপের লক্ষ্যে যৌথ এক পরিষদ গড়ে তোলেন। পোল্যান্ডের গির্জার বিশপ ও সৌদি আরবের বাদশাহ এই পরিষদকে সহযোগিতা করছেন। ইউরোপে এরকম আর দ্বিতীয়টি নেই। পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আগাটা নালবোরচিক জানান, ‘আমাদের লক্ষ্য খ্রিস্টানদের ইসলাম আর মুসলমানদের খ্রিস্টধর্মের কাছাকাছি নিয়ে আসা। প্রথমে আমাদের পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত হতে হবে। ইসলাম সম্পর্কে অনেক কিছু বলা হচ্ছে। সব মুসলিমই সন্ত্রাসী ও কট্টরপন্থী নয়, সেটা সুস্পষ্ট করতে কাজ করে যাচ্ছি।’
দুই ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে সংলাপ জোরদার করতে পরিষদের পক্ষ থেকে আয়োজিত হচ্ছে সম্মেলন ও আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রকাশিত হয় বইপুস্তক এমনকি ক্যাথলিক ও মুসলিমদের এক সঙ্গে প্রার্থনারও আয়োজন করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বে রয়েছেন ক্যাথলিক খ্রিস্টান ও ইসলাম উভয় ধর্মের অনুসারীরা, যাতে দুই ধর্মেরই সমমর্যাদা প্রকাশ পায়। মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করছেন আর্তুর কনোপাকি। তিনি বলেন, ‘আলোচনা অনুষ্ঠানে আমরা আমাদের ধর্মের নানা দিক তুলে ধরি। বাস্তবে খ্রিস্টধর্ম ও ইসলামের মধ্যে অনেক মিল রয়েছে। এ মিলগুলোই আমাদের খুঁজে বের করতে হবে, পার্থক্য নয় (রায়হানা বেগম, ডয়চে ভেলে, ৩০ ডিসেম্বর- ২০০৯)।
বুহুনিকি এলাকায় একটি মসজিদ নির্মাণের জন্য রাজা তৃতীয় সোবিস্কি মুসলমানদের একখণ্ড জমি দান করেন। শিক্ষা গ্রহণ, ভূমি ক্রয়, মসজিদ নির্মাণ, বাসস্থান তৈরি, ব্যবসায় পরিচালনা ও স্থানীয় মেয়েদের বিয়ে করার ক্ষেত্রে মুসলমানদের জন্য সুযোগ অবারিত হয়। বুহুনিকি ও কুরুসজিনিয়ানিতে মসজিদ দু’টি তুলনামূলকভাবে অতি প্রাচীন। বিয়ালিস্টকে রয়েছে ইসলামি কেন্দ্র, যেখানে মুসলমানদের সংখ্যা প্রায় এক হাজার ৮০০।
পোল্যান্ডে জন্ম নেওয়া বহু মুসলমান শিক্ষা, প্রশাসনসহ বিভিন্ন বিভাগে চাকরি করছেন। ড. আলী মিসকভজিস বিয়ালিস্টক বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ড. সলিম চাসভিজেউক্স ওয়ারামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। মুসলিম তাতাররা ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে পোল্যান্ডের জীবনধারার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম হয়েছেন। তারা মাতৃভাষা ত্যাগ করে স্লোভাকিয়ান বাকরীতি গ্রহণ করেছেন।
এ দেশে দাওয়াতি তৎপরতা চালাতে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। আধ্যাত্মিক শান্তির অন্বেষায় পোল যুবক, শিল্পী ও ছাত্ররা ইসলামের দিকে ক্রমশ ঝুঁকে পড়ছেন। দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন সমস্যার ইসলামি সমাধান প্রাপ্তির লক্ষ্যে তাতারদের রয়েছেন থোমাস মিসকিউজ নামে একজন মুফতি।
রাজধানী ওয়ারশতে মুসলমানদের রয়েছে নিজস্ব মসজিদ, কোরআন শিক্ষাকেন্দ্র, হালাল খাদ্যের স্টল ও কবরস্থান। ওয়ারশ কেন্দ্রীয় মসজিদে জুমার দিন তিন শতাধিক মুসলমান নামাজ আদায়ের জন্য জড়ো হন। রাজধানীর পাঁচ হাজার মুসলমানের মধ্যে বেশিরভাগ উচ্চ শিক্ষিত। পোলিশ ভাষায় পবিত্র কোরআনের একটি অনুবাদ এবং ইমাম নববির ৪০ হাদিস নামক একটি হাদিস গ্রন্থের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা বেরিয়েছে। পোজনান এলাকায় কোনো মসজিদ না থাকলেও মুসলমানরা স্থানীয় ছাত্রাবাসে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে থাকেন।
পোল্যান্ডে বিভিন্ন মুসলিম সংগঠনের মধ্যে ১৯১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত পোলিশ মুসলিম ইউনিয়ন ও ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম স্টুডেন্টস সোসাইটির কর্মতৎপরতা বেশ চোখে পড়ার মতো। মুসলিম ইউনিয়নের তত্ত্বাবধানে কোরআন, হাদিস, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশের লক্ষ্যে পোলিশ ও ইংরেজি ভাষায় বিভিন্ন ম্যাগাজিন বের হয় নিয়মিত। তন্মধ্যে ‘মুসলিম ওয়ার্ল্ড রিভিউ’, মাসিক ইসলামিক ম্যাগাজিন ‘আলিফ’ উল্লেখযোগ্য। মুসলিম স্টুডেন্টস সোসাইটি মুসলিম শিশুদের ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে বেশ কিছু শিক্ষাকেন্দ্র চালু করেছে। সোসাইটির ব্যবস্থাপনায় প্রতি বছর বিভিন্ন দিবসে মাহফিল, সেমিনার, সংলাপ ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সংগঠনটি ইতোমধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে ২২টি গ্রন্থ ‘আল হাদারা’ নামক একটি আরবি ত্রৈমাসিক এবং ‘হিকসা’ নামে ম্যাগাজিন প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছে। ‘হিকমা’ এ পর্যন্ত ৪২টি সংখ্যা বেরিয়েছে। মুসলিম ছাত্রদের মাদরাসা ও স্কুলে পড়ালেখায় উদ্বুদ্ধকরণ ও ভর্তির ব্যাপারে পরামর্শ দেওয়া সোসাইটির অন্যতম প্রধান কর্মসূচি। স্কলারদের মাধ্যমে পোলিশ ভাষায় পবিত্র কোরআনের তরজমাসহ নির্ভরযোগ্য একটি তাফসির প্রকাশ, রাজধানী ওয়ারশতে উচ্চতর ইসলামি শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন এবং ইসলামি পাঠাগার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন মুসলিম সংগঠনের নেতারা সমন্বিত পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন।
পোল্যান্ডে ইসলামের বিধি-বিধান প্রতিপালনে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির লক্ষ্যে মুসলমান নেতারা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে একটি আইনের খসড়া তৈরিতে সক্ষম হয়েছেন। এ আইন কার্যকর হলে ১৯৩৬ সালের আইন বাতিল হয়ে মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক অধিকার নিশ্চিত হবে। খসড়া আইনের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে রয়েছে- ক. মসজিদে ইমাম ও খতিবদের তত্ত্বাবধানে মুসলমানদের যেসব বিয়ে সম্পন্ন হবে, তা সিভিল ম্যারেজ হিসেবে আইনি মর্যাদা পাবে, খ. উলামা-মাশায়েখ কর্তৃক যেকোনো খাদ্যদ্রব্যের জন্য প্রদত্ত ‘হালাল সার্টিফিকেট’ রাষ্ট্রীয়ভাবে গ্রহণযোগ্য হবে, গ. ধারালো ছুরি দিয়ে গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ, দুম্বা, হাঁস, মুরগি ও কবুতরের গলা দিয়ে জবাই করলে এবং জবাই করার সমং ‘আল্লাহু আকবার’ বললে কেবল মুসলমানরা সে গোশত খেতে পারবেন, ঘ. ঈদসহ মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসবগুলো ছুটির দিন হিসেবে গণ্য হবে, ঙ. ধর্মীয় ও সামাজিক বিধি-বিধান পালনে প্রয়োজনে মুসলমানরা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ছুটি নিতে পারবেন। এ আইন পোল্যান্ডে ইসলামের বিকাশ এবং সে দেশে অবস্থানরত মুসলমানদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা সংরক্ষণে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
পোল্যান্ডের এ প্রশংসনীয় পরিস্থিতি পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত মুসলমানদের মনে নতুন আশার সঞ্চার করে।