চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি রাজধানীর কাকরাইলে মা ও ছেলেকে গলা কেটে হত্যার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় তিন আসামির মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করেছেন ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ রবিউল আলম। রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, ‘মহান আল্লাহ আমাদের যে সব নিয়ামত দান করেছেন তার মধ্যে সুসন্তান অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিয়ামত। সন্তানের আশা-ভরসার শেষ আশ্রয়স্থল হলো তার পিতা। আর স্ত্রী হলেন সহর্ধমিনী, অর্ধাঙ্গিনী ও সন্তানের জননী। সেকারণে প্রত্যেক স্ত্রী তার স্বামীর কাছে সম্মানের পাত্রী। স্বামীর কাছে স্ত্রীর রয়েছে বহুমাত্রিক অধিকার। স্বামী ও স্ত্রী একে অন্যের সহায়ক ও পরিপূরক। সূরা বাকারার একটি আয়াত তুলে ধরে বিচারক বলেন, আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কে বলেন, তারা তোমাদের আবরণ এবং তোমরা তাদের আবরণ।’ -সূরা আল বাকারা: ১৮৭
ইসলাম ধর্ম শান্তি ও সত্যের ধর্ম। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনের সূরা মায়িদার ৩২ নম্বর আয়াত তুলে ধরে বিচারক আরও বলেন, ‘যে কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করে, অন্য কোনো প্রাণের বিনিময় ব্যতীত কিংবা পৃথিবীতে কোনো ফ্যাসাদ সৃষ্টির অপরাধ ছাড়া, সে যেন সকল মানুষকে হত্যা করল।’
প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের ১ নভেম্বর কাকরাইলের পাইওনিয়র গলির ৭৯/১ নম্বর বাসার গৃহকর্তা আবদুল করিমের প্রথম স্ত্রী শামসুন্নাহার করিম (৪৬) ও তার ছেলে শাওনকে (১৯) হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ঘটনার পরদিন রাতে নিহত শামসুন্নাহারের ভাই আশরাফ আলী বাদী হয়ে রমনা থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলায় আব্দুল করিম, আব্দুল করিমের দ্বিতীয় স্ত্রী শারমিন মুক্তা, মুক্তার ভাই জনিসহ অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি করা হয়।
শুধু এই মামলায় নয়, আরও অনেক মামলার রায়েই বিচারকদের পবিত্র কোরআন-হাদিস থেকে বিভিন্ন উদ্ধৃতি দিতে দেখা গেছে। বহুল আলোচিত পিলখানা হত্যা মামলার রায়ে কোরআনে কারিমের সূরা নিসার ৯৩ নম্বর এবং সূরা মায়েদার ৪৫ নম্বর আয়াতের উদ্ধৃতি তুলে ধরে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি পিলখানা হত্যা মামলায় ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় (ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিলের ওপর) প্রকাশিত হয়। বিচারপতি মো. শওকত হোসেন, বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদারের স্বাক্ষরের পর এ রায় প্রকাশ করা হয়।
বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী তার পর্যবেক্ষণে বলেন, পবিত্র কোরআনের সূরা নিসার ৯৩ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় কোনো ঈমানদারকে হত্যা করবে, তার শাস্তি জাহান্নাম। সে চিরকাল সেখানেই থাকবে। আল্লাহ তার প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছেন, তাকে অভিসম্পাত করেছেন এবং তার জন্য কঠোর শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন।’ হাদিসে এসেছে, উহুদের যুদ্ধ চলাকালে একজন মুসলমান অপর এক মুসলমানকে ব্যক্তিগত শত্রুতার জেরে হত্যা করে। নবী করিম (সা.) অহির মাধ্যমে এ সম্পর্কে অবহিত হন এবং যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে হত্যাকারীকে কিসাস করার অর্থাৎ অনুরূপ শাস্তি দেওয়ার নির্দেশ দেন এবং তার ক্ষমা প্রার্থনাও তিনি প্রত্যাখ্যান করেন।’
রায়ের পর্যবেক্ষণে আরও উল্লেখ করা হয়, কোরআনে কারিমের সূরা বাকারার ১৭৯ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, ‘হে বুদ্ধিমানগণ! কিসাসের মধ্যে তোমাদের জন্য জীবন রয়েছে যাতে তোমরা সাবধান হতে পারো।’ এ ছাড়া রায়টির পর্যবেক্ষণ অংশে সূরা মায়েদার ৪৫ নম্বর আয়াত এবং প্রখ্যাত কয়েকজন মনীষী ও অপরাধ বিজ্ঞানীর উদ্ধৃতি তুলে ধরা হয়।’
সূরা মায়েদার ৪৫ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি এ গ্রন্থে তাদের প্রতি লিখে দিয়েছি যে, প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ, চক্ষুর বিনিময়ে চক্ষু, নাকের বিনিময়ে নাক, কানের বিনিময়ে কান, দাঁতের বিনিময়ে দাঁত এবং জখমসমূহের বিনিময়ে সমান জখম। অতঃপর যে ক্ষমা করে, সে গোনাহ থেকে পাক হয়ে যায়। যেসব লোক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফয়সালা করে না তারাই জালেম।’
২০১৭ সালে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়েও পবিত্র কোরআনের উদ্ধৃতি দেওয়া হয়। উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে অর্পণসংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীকে বাতিল ঘোষণা করে আপিল বিভাগের দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রায়ে কোরআন থেকে ন্যায়বিচারসংক্রান্ত একটি আয়াত উল্লেখ করা হয়। রায়ের ৭০৬ নম্বর পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা সূরা নিসার ১৩৫ নম্বর আয়াতটির অর্থ হলো- ‘হে ইমানদারগণ! আল্লাহকে সাক্ষী রেখে ন্যায়বিচারের ওপর অটল থাক, যদিও এটা তোমাদের, তোমাদের বাবা-মায়ের এবং আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধে যায়; হোক ধনী অথবা গরিব- সবাই আল্লাহর মুখাপেক্ষী। যদি ন্যায়বিচার অস্বীকার করো অথবা ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করো, তবে জেনে রাখো, আল্লাহ তোমাদের সব কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবগত।’
২০১৯ সালের জুলাই মাসে নদী দখল ও দূষণরোধে দেওয়া ‘নদী সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায়ে’ও পবিত্র কোরআনের আয়াত উদ্ধৃতি করা হয়েছে। ২৮৩ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টির দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় কোরআনে কারিমের একটি আয়াতের অর্থ ‘প্রাণবন্ত সবকিছুই পানি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে’ (সূরা আম্বিয়া, আয়াত ৩০) উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর একটি ইংরেজি দৈনিকে নদ-নদীদখল সংক্রান্ত বিষয়ে একটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে হাইকোর্টে রিট আবেদন দায়ের করেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। পরে ওই রিটের ওপর জারি করা রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট রায় ঘোষণা করেন। ১ জুলাই রায় ঘোষণাকারী বিচারপতিদের স্বাক্ষরের পর রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়।
পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, বিভিন্ন সময়ই আদালত রায়ের পর্যবেক্ষণে অপরাধের বিষয়ে ধর্মের শিক্ষা তুলে ধরতে বিচারিক বিধানের বাইরে ইসলামের বিধান হিসেবে কোরআন ও হাদিস থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে থাকেন। কোনো কোনো সময় নাগরিক অধিকার ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিষয়ে ইসলামের শিক্ষা তুলে ধরতে মদিনা সনদ, কোরআনের একাধিক সূরার একাধিক আয়াত ও নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর বিদায়ী হজের ভাষণও তুলে ধরা হয়েছে বিভিন্ন রায়ে।
আমরা জানি, মানবজীবনে ন্যায়বিচারের গুরুত্ব অত্যধিক। সভ্য সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের কোনো বিকল্প নেই। সুবিচারপ্রাপ্তি সব নাগরিকের অধিকার এবং ন্যায়বিচার আল্লাহর হুকুম। এটি একটি ফরজ ইবাদত। কোরআনে কারিমে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায় সাক্ষ্যদানে তোমরা অবিচল থাকবে, কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদের যেন কখনও সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে, সুবিচার করবে, এটা তাকওয়ার নিকটতর এবং আল্লাহকে ভয় করবে, তোমরা যা করো নিশ্চয় আল্লাহ তার সম্যক খবর রাখেন।’ -সূরা মায়িদা: ৮
বস্তুত ন্যায়ের বিধান সর্বকালের ও সব সমাজের জন্য। আর কোরআনে কারিম তথা ধর্মীয় বিধানের উদ্দেশ্য হলো- মানবকল্যাণ। অবিনশ্বর ও চিরন্তন অলৌকিকতায় ভরপুর পবিত্র কোরআন। কোরআনে কারিমই একমাত্র আসমানি গ্রন্থ, যা সব যুগে মানুষকে কল্যাণের অশেষ ধারায় সিক্ত করতে সক্ষম। কোরআন অলৌকিক বিস্ময়ের অশেষ উৎস। জ্ঞানের এই অতলান্ত সাগরের মুনি-মুক্তার ভাণ্ডার থেকে যতই মনি-মুক্তা আহরণ করা হোক না কেন, তা চিরকালই অজস্র ও অপরিমেয় থেকে যাবে।
ইসলামি স্কলারদের মতে, পবিত্র কোরআন সৃষ্টি জগতের নানা রহস্য, উচ্চতর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা, নৈতিক ও জীবন গড়ার শিক্ষাসহ অশেষ জ্ঞান এবং তথ্যের উৎসে ভরপুর। কোরআনে কারিমের উপযোগীতা সব যুগে এবং সব স্থানেই কার্যকর। পবিত্র কোরআনের মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের কারণেই এর প্রতি মুসলমানরা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আসছেন। নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মোজেজা এই কোরআন থেকেই উদ্ভুত। তিনি মানুষকে এ মহাগ্রন্থের মাধ্যমে মুক্তি ও সৌভাগ্যের দিশা দেখিয়ে গেছেন। এখনও বিশ্ববাসী যদি কোরআনের পথে, কোরআনের বলা আদর্শের পথে নিজেদের পারিচালিত করে তবে মুক্তি ও সৌভাগ্য মিলবে- ইনশাআল্লাহ।