ইসলামপূর্ব যুগে বিদ্যমান ধর্মগুলোতে মাদকদ্রব্য সম্পর্কে কোনোরূপ বিধি-নিষেধ ছিলো না। অন্যদিকে সেসময়কার চিকিৎসকরাও নেশা জাতীয় দ্রব্যের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন না। সে সময় উপাসনালয়ে মাদবসেবন চলতো। সমাজের এমন সন্ধিক্ষণে মানুষদের ভালো কাজ ও নৈতিক চরিত্র সংশোধনে উদ্বুদ্ধ করার জন্য এমন ব্যক্তির প্রয়োজন ছিলো- যিনি তাদের অন্তরে প্রভাব সঞ্চারের যোগ্যতা রাখেন। এ মিশন বাস্তবায়নে নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আদিষ্ট হন। তাকে এই মর্মে মূলনীতি বাতলে দেওয়া হয়, ‘মানুষকে মমতাপূর্ণপন্থা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে তোমার প্রভুর পথে আহ্বান করো।’
ইসলামের লক্ষ্য হলো, এমন নীতিমালা ও উপায় নির্দেশ করা- যাতে মানুষ মর্যাদাপূর্ণ, সুস্থ-সবল দীর্ঘজীবন লাভ করতে পারে। মানুষের অধিবাস, আবাসন, পারস্পরিক উঠাবসা ও পরিচ্ছন্নতার শিক্ষা দিতে গিয়ে যখন দেখা গেলো, মানবজীবনে নেশা ও মাদকের প্রভাব অত্যন্ত নেতিবাচক তখন কোরআন মজিদ একেবারে গোড়াতেই নির্দেশনা দিলো- ‘লোকেরা আপনার কাছে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জানতে চাইবে, আপনি তাদেরকে বলুন; এতে অনেক রকমের ক্ষতির পাশাপাশি সামান্য উপকারিতাও আছে।’ -সূরা বাকারা: ২১৯
এটা একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ের কথা। যে কারণে আয়াতের নির্দেশনা অনেকটা পরামর্শের মতো করে বলা হয়েছে। এরপর দেখা গেল, লোকেরা এমনভাবে নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে যে, এর ফল পারস্পরিক ঝগড়া-ফাসাদ পর্যন্ত গড়াচ্ছে। তখন আল্লাহর রাসূল (সা.) বললেন, ‘তোমরা মাদকদ্রব্য থেকে দূরে থাকো কারণ এটি নষ্টের মূল’ (যুহরি)। এবার মানুষ যখন তার কথা গুরুত্ব দেওয়া ও বিষয়টি বোঝার পর্যায়ে এলো, তখন কোরআন মজিদ ঘোষণা করে, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নামাজ পড়া থেকে বিরত থাকো। এ নিষেধাজ্ঞা সে পর্যন্ত বলবৎ থাকবে যতক্ষণ না তোমরা নিজেদের কথাবার্তা ও কাজের ওপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাও।’
প্রথম শর্ত এই মর্মে দেওয়া হয়েছে যে, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নামাজ পড়া যাবে না। মানুষ যখন এটা জানতে পারলো যে, মাদকে এমন প্রতিক্রিয়া আছে যা নামাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে এবং নেশাগ্রস্ত হওয়ার কারণে আল্লাহর জিকির কিংবা ইবাদত একাগ্রতা ও গভীর অভিনিবেশে করা যায় না। এতে মদ্যপায়ীরা নড়েচড়ে বসলেন। এরপরের ধাপে নেশার কারণে জননিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার বিষয়টি সামনে আনা হলো এভাবে-
‘যারা আল্লাহ ও তার রাসূলের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেছে, তাদেরকে জানিয়ে দেওয়া হলো- মদ, জুয়া, মূর্তিপূজা (ভাস্কর্য বা যা কিছু স্থাপন করা হয়), ভাগ্যনির্ণায়ক বস্তু অপবিত্র ও শয়তানি কর্ম। শয়তান মানুষকে এসবের প্ররোচণা দেয়। কারণ এর ফলে ঝগড়া-ফাসাদ ও পারস্পরিক শত্রুতা তৈরি হয়। এসব আল্লাহর স্মরণের প্রতিবন্ধক, কারণ নেশা অবস্থায় মুখ দিয়ে ভালো কথা বের হয় না।’ -সূরা মায়েদা: ৯০-৯১
প্রত্যেক ধরনের নেশার দু’টি প্রভাব হয়ে থাকে। এক. মাদক সেবন বা গ্রহণের পর মানুষ অসংলগ্ন বকতে থাকে, ঝগড়া করে। ফলে দেখা যায়, মদপানের পর ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব পরস্পরের ঝগড়ায় জড়িয়ে শত্রুতে পরিণত হয়। দুই. এর দীর্ঘমেয়াদী কিছু ক্ষতি রয়েছে। এর মধ্যে হৃদযন্ত্র ও স্নায়ুতন্ত্র আক্রান্ত হওয়া অন্যতম।
নেশার বিষয়ে কোরআন মজিদ বিধানগত অবস্থান পরিষ্কার করতে যাচ্ছে, এমন সময়ে নবী করিম (সা.) একটি হুকুম জারি করলেন, হজরত আনাস (রা.) বলেন, একটি আসরে আমার চাচা ও অন্যদের মদের পেয়ালা পরিবেশন করছিলাম। এমন সময় একজন ঘোষকের আওয়াজ ভেসে এলো, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) মদ্যপান নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। তাৎক্ষণিকভাবে সবাই হাতের পেয়ালা ছুঁড়ে ফেলে এবং আমি মদের ভাণ্ড ভেঙে দিলাম।
এবার প্রশ্ন জাগে, প্রচলিত ধারণায় কেবল মদকে নেশাদ্রব্য বলা হয় কিন্তু যেকোনো নেশার দ্রব্যই মনস্তাত্ত্বিক, শারীরিক ও সামাজিক সমস্যা তৈরি করতে পারে। ব্যাপারটি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) অত্যন্ত চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন, ‘প্রত্যেকটি মাদকতা সৃষ্টিকারী বস্তু মাদক আর নেশা আনে এমন সবকিছুই হারাম।’ –সুনানে আবু দাউদ: ৩১৯৭
একই বিষয়ে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.), হজরত আবদুল্লাহ ইবন্ মাসউদ (রা.) ও হজরত আয়েশা (রা.)-এর হাদিস রয়েছে। যা উক্ত হাদিসের মর্মকে সমর্থন করে।
পরবর্তী ধাপের প্রশ্নটি উঠে পরিমাণ প্রসঙ্গে। ফ্রান্সে মাদকাসক্ত তরুণদের চিকিৎসক এক মনস্তত্ত্ববিদ বলেন, অল্প পরিমাণ মাদক গ্রহণে ছোটদের আসক্তি তৈরি হয় কিন্তু তার বয়স যতই বাড়তে থাকে চাহিদাও ক্রমাগত বাড়ে। অথবা বলা যায়, তখন শরীর অভ্যস্ত হয়ে ওঠায় অল্পে আর তৃপ্তি আসে না। কাজেই ধীরে ধীরে পরিমাণ বাড়াতে হয়।
হজরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বর্ণনা করেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে বস্তু বেশি পরিমাণে নেশা আনে তার অল্প পরিমাণও হারাম।’ নেশা জাতীয় বস্তুর ক্ষতিকর দিক বিবেচনায় নিয়ে আল্লাহর রাসূল এটাকে সাধারণভাবেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তিনি এখানে থামেননি, বরং চিকিৎসার ক্ষেত্রে এর ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছেন। তবে সোজাসাপ্টা হুকুম জারি না করে এর ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, এটা আদৌ চিকিৎসা নয় বরং তা নিজেই একটি ব্যাধি অথবা রোগব্যাধির বীজ।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলের বন্ধু যিনি সাকিফ গোত্রের লোক ছিলেন। রাসূলের জন্য উপহার হিসেবে বেশি পরিমাণে মদ নিয়ে হাজির হন। তাকে সম্বোধন করে রাসূলে আকরাম (সা.) বলেন, ‘ওহে অমুক! তোমার কি জানা নেই যে, আল্লাহ মদকে নিষিদ্ধ করেছেন? লোকটি নিচুস্বরে তার ক্রীতদাসকে বললো, মদগুলো যেন বাজারে গিয়ে বিক্রি করে দেয়। এটা শুনে রাসূল (সা.) বললেন, যিনি এটা পান করা নিষিদ্ধ করেছেন তিনি এর বেচাবিক্রিও নিষিদ্ধ করেছেন। এ কথা শোনার পর লোকটি সমস্ত মদ নালায় ঢেলে দেয়।’ –আহমদ, মুসলিম ও নাসায়ী
হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.)-এর পিতা একটি এতিম বাচ্চার লালন-পালন করছিলেন। বাজারে মদের দাম সুবিধাজনক দেখে তিনি এই এতিম বালকের সম্পদ থেকে মদ কিনে নিয়ে মজুদ করলেন ঠিক এ সময়েই মদ নিষিদ্ধ হলো। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এখন কী করবো? তাকে বলা হলো- জ্বালিয়ে দাও। তিনি নিবেদন করলেন, এটা তো এতিমের সম্পদ! সে এই ক্ষতিবহন করার সামর্থ রাখে না! আরজ করলো, এটাকে আমি সিরকা অথবা ভিনেগার বানিয়ে নিতে পারি না? জবাবে বলা হলো- না।
এ প্রসঙ্গে হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসূল মদ দিয়ে সিরকা বানাতেও বারণ করেছেন। এ ব্যক্তব্যটি হজরত আনাসের উক্ত হাদিস দ্বারা এরূপ শব্দ সমর্থিত হয়। যা ইমাম তিরমিজি, মুসলিম ও আবু দাউদ বর্ণনা করেছেন।
নেশা একটি অভ্যাস, কেউ যখন এতে জড়িয়ে পড়ে সে তার অপর দুরাচার বন্ধুকে এতে আসক্ত দেখে আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। যদি নেশার বস্তু সম্পর্কে তার মধ্যে এভাবে ঘৃণা ও বিতৃষ্ণা তৈরি করা যায়, এটি নোংরা ও ক্ষতিকর জিনিস- তাহলে সে এটা ছাড়তে বাধ্য হবে।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, নবী করিম (সা.) প্রত্যেকটি নেশার জিনিস ব্যবহারকে অভিশাপ বলেছেন। এর ওপর দশদিক থেকে অভিশাপ রয়েছে। মদ প্রস্তুতকারী, মদ প্রস্তুতের হুকুমদাতা ও ব্যবস্থাপক, মাদকদ্রব্য বিক্রেতা, গ্রাহক, বহনকারী, যার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়, যারা নেশার উপার্জন ভোগ করে, মদ পরিবেশনকারী ও পানকারী সকলেই অভিশপ্ত।’ –ইবনে মাজা
মদের উৎপাদন, বিপণন, পরিবহন ইত্যাদি প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত সবাইকে অভিশপ্ত সাব্যস্ত করার মাধ্যমে মাদকবাণিজ্য প্রবলভাবে নিরুৎসাহিত করার ইসলামের অনন্য ও ব্যতিক্রম মনস্তাত্ত্বিক কৌশল।
অনুবাদ: খন্দকার মুহাম্মদ হামিদুল্লাহ