সূরা আয-যুমারের ৫৯ ও ৬০ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘হ্যাঁ, তোমার কাছে আমার নিদর্শনাবলী এসেছিল, কিন্তু তুমি সেগুলোকে মিথ্যা বলেছিলে; অহংকার করেছিলে এবং কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছিলে।’ ‘যারা আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করে, কিয়ামতের দিন আপনি তাদের মুখমণ্ডলকে কৃষ্ণকায় দেখতে পাবেন। অহংকারীদের আবাসস্থল জাহান্নামে নয় কি?’
উল্লেখিত আয়াতদ্বয়ের তাফসিরে বলা হয়েছে, আল্লাহতায়ালা মানুষের কাছে সত্যের দাওয়াত পৌঁছে দিতে কার্পণ্য করেননি বরং সত্যপথ প্রদর্শনের সব ব্যবস্থা সম্পন্ন করেছেন। পৃথিবীতে মানুষের হেদায়েতের জন্য কিতাবসহ নবী-রাসূল পাঠানো হয়েছিল। সুতরাং মানুষগণ যদি নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তিকে কাজ লাগিয়ে সত্য উপলব্ধি করতে পারত তাহলে হেদায়েতের বাণী কাজে আসত।
কিন্তু দম্ভ ও অহংকার করার কারণে অনেক মানুষ সত্য ধর্ম প্রত্যাখ্যান করেছে এবং নবী-রাসূলদের দাওয়াত গ্রহণ করা থেকে বিরত থেকেছে। পরিণতিতে তাদের স্থান হয়েছে জাহান্নাম। আর পার্থিব জীবনের পাপাচারের কারণে জাহান্নামের অধিবাসীদের মুখমণ্ডল কৃষ্ণকায় হয়ে যাবে এবং তারা পরস্পরের প্রতি ত্যক্ত-বিরক্ত থাকবে।
নিঃসন্দেহে আল্লাহর বাণী প্রত্যাখ্যানকারীদের এই কালো রূপ কিয়ামতের দিন তাদেরকে চরম অপমানকর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দেবে। পার্থিব জীবনে মানুষ যেসব কাজ ও আচরণ করে এবং যা কিছু বলে তার পরিণতি কিয়ামতের দিন তার সামনে প্রতিভাত হয়ে উঠবে। পৃথিবীর জীবনে যারা কালো অন্তরের অধিকারী এবং যাদের কর্মও কালোর মতো অন্ধকার কিয়ামতের দিন সেসব মানুষের অন্তরের এই কালিমা মুখমণ্ডলে প্রকাশ পাবে।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো-
১. আল্লাহতায়ালা মানুষকে বুদ্ধিবৃত্তি দান করার পাশাপাশি তার কাছে অহির মাধ্যমে হেদায়েতের বাণী পৌঁছে দেওয়ার আগ পর্যন্ত তাকে আজাব দেন না।
২. সত্যবাণী প্রত্যাখ্যান ও কুফরের মূল উৎস হচ্ছে অহংকার ও আত্মম্ভরী মনোভাব।
৩. কিয়ামতের দিন মানুষের অন্তর ও বাহির সমানভাবে প্রকাশ হয়ে পড়বে। তার অন্তরে যা কিছু আছে তা তার মুখণ্ডলে প্রকাশ পাবে।
এর পর সূরা যুমারের ৬১ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘আর যারা তাকওয়া অবলম্বন করত, আল্লাহ তাদেরকে তাদের সাফল্য অর্জনকারী কর্মের মাধ্যমে মুক্তি দেবেন; তাদেরকে কোনো অনিষ্ট স্পর্শ করবে না এবং তারা দুঃখিতও হবে না।’
অর্থাৎ আল্লাহতায়ালা তাকওয়া অবলম্বনকারী ব্যক্তিকে মুক্তি দেবেন এবং সৌভাগ্যবানদের সঙ্গে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। সৌভাগ্য হচ্ছে চিরস্থায়ী শান্তি ও তৃপ্তি। পার্থিব জীবনে আমরা যখন অনেক মজাদার খাবার খাই ও সুস্বাদু পানীয় পান করি তখন আমরা তৃপ্তি পাই। কিন্তু এটি সৌভাগ্যের লক্ষণ নয়। কারণ, এ ধরনের তৃপ্তি স্থায়ী হয় না বরং কিছুক্ষণ পরই আবার ক্ষুধার অনুভূতি জেগে ওঠে। পার্থিব জীবনের যেকোনো তৃপ্তিদায়ক বিষয়ই ক্ষণস্থায়ী। যুক্তির খাতিরে যদি ধরেও নেই যে, কারও জীবনে পার্থিব সুখ দীর্ঘ সময় ধরে টিকে থাকে তারপরও পরকালীন চিরস্থায়ী জীবনের তুলনায় তা অনেক বেশি ক্ষণস্থায়ী। এ দু’টি জীবন তুলনাযোগ্য নয়। কাজেই কিয়ামতের দিন যে সৌভাগ্যবান হবে সেই প্রকৃত সুখী এবং সেই চিরস্থায়ী জীবনে তার কোনো ভয়, দুঃখ বা উদ্বেগ থাকবে না।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো-
১. পার্থিব জীবনে তাকওয়া অবলম্বন পারলৌকিক জীবনে সৌভাগ্যের চাবিকাঠি।
২. তাকওয়া দুনিয়ার জীবনে মানুষকে গোনাহ, অশ্লীলতা ও অপবিত্রতা থেকে রক্ষা করে। নিজেকে গোনাহমুক্ত রাখার এই অনুশীলনের কারণে কিয়ামতের দিন মুত্তাকি ব্যক্তি সব ধরনের আজাব ও কষ্ট থেকে রক্ষা পাবে।
এই সূরার ৬২ ও ৬৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা আরও বলছেন, ‘আল্লাহ সব কিছুর স্রষ্টা এবং তিনি প্রতিটি জিনিসের রক্ষণাবেক্ষণকারী।’ ‘আসমান ও জমিনের চাবি তারই কাছে (রয়েছে)। আর যারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে প্রত্যাখ্যান করে, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত।’
বর্ণিত আয়াতের তাফসিরে বলা হয়েছে, গোটা বিশ্বজগত পরিচালনা, সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সেই সত্ত্বা পালন করছেন যিনি এই জগত সৃষ্টি করেছেন। তিনি এ জগত সৃষ্টি করার পর ক্লান্ত হয়ে পড়েননি বা এটি পরিচালনার দায়িত্ব অন্য কারও কাছে হস্তান্তর করেননি। এই আয়াতের বক্তব্য বিশেষ করে মুশরিক ও মূর্তিপূজকদের উদ্দেশ করে বলা হচ্ছে। অনেক মুশরিক আছে, যারা সৃষ্টিকর্তা হিসেবে আল্লাহর অস্তিত্ব স্বীকার করলেও তাদের কল্পিত দেব-দেবীকে জীবন পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত মনে করে তাদের পূজা করে।
পবিত্র কোরআনের এই আয়াত অনুযায়ী যারা বিশ্বজগত পরিচালনার পাশাপাশি মানুষের জীবন পরিচালনায় আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও ভূমিকা আছে বলে মনে করে, তারা প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ। কারণ যে আল্লাহ গোটা সৃষ্টিজগতের মালিক এবং আসমান ও জমিনের চাবি যার হাতে রয়েছে তার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে দুর্বল ও অক্ষম কল্পিত পালনকর্তাদের কাছে গেলে কোনো লাভ নেই। এসব কল্পিত স্রষ্টা এতটাই অক্ষম যে, নিজেদের ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতাও তাদের নেই। কাজেই তাদের পক্ষে তাদের উপাসনাকারীদেরকে বিপদ-আপদ থেকে উদ্ধার করা বা ক্ষতির হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব নয়।
আয়াতের শিক্ষণীয় কয়েকটি দিক হলো-
১. বিশ্বের সমস্ত সৃষ্টি বাঁচা ও টিকে থাকার জন্য আল্লাহতায়ালার অনুগ্রহের মুখাপেক্ষী। অন্য কথায়, তিনি একইসঙ্গে বিশ্বজগতের স্রষ্টা এবং পালনকর্তা। এই দুই বিষয়ের যেকোনো একটিতে আল্লাহর পাশে অন্য কাউকে বসালেই সেটি শিরক বলে বিবেচিত হবে এবং শিরকের গোনাহ তওবা ছাড়া মাফ হবে না।
২. তাওহিদ এমন একটি বিষয়, যা মানুষের জীবনের প্রতিটি অংশের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে এবং এর কোনো অংশ থেকেই তাওহিদকে আলাদা করা সম্ভব নয়।