জুলুমের অর্থ হলো- অত্যাচার, নির্যাতন, অবিচার। সাধারণ অর্থে কাউকে অন্যায়ভাবে শারীরিক, মানসিক, আর্থিক বা যেকোনো পন্থায় নির্যাতন করাকে জুলুম বলে। জুলুমের সবচেয়ে উত্তম সংজ্ঞা হলো, কোনো কিছু নিজ স্থান বাদ দিয়ে অন্য কোনো স্থানে প্রয়োগ করা। এই সংজ্ঞাটি ব্যাপক অর্থবহ। সব ধরনের জুলুম এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়।
জুলুম একটি সামাজিক ব্যাধি। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বত্র ব্যাপক আকার ধারণ করেছে এটি। অন্যের ওপর অবিচার করে নিজের পতন ও ধ্বংস ডেকে আনে অত্যাচারীরা। আপদ-বিপদ ও দুর্যোগ-বিশৃঙ্খলায় আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম কারণ জুলুম। আল্লাহতায়ালা সবাইকে জুলুম থেকে বিরত থাকার আদেশ দিয়েছেন। এমনকি আল্লাহ নিজের জন্যও এটিকে হারাম করেছেন। হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদিসে কুদসিতে আল্লাহর কথা বর্ণনা করে বলেন, ‘হে আমার বান্দা, আমি নিজের ওপর জুলুম হারাম করেছি এবং তোমাদের জন্যও তা হারাম করেছি। অতএব তোমরা একে অপরের ওপর জুলুম করো না।’ –সহিহ মুসলিম: ৬৭৩৭
এটা স্পষ্ট যে, জুলুম একটি ভয়াবহ পাপ। যে পাপ আল্লাহতায়ালা সহজে ক্ষমা করবেন না। কেউ যদি কাউকে জুলুম করে নিপীড়িতের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। অন্যথায় মাফ হবে না। কিয়ামতের ময়দানে প্রতিটি অপকর্মের জন্য কড়ায়গণ্ডায় হিসাব দিতে হবে।
কোরআনে কারিমে আল্লাহতায়ালা মুসলিম নর-নারীকে সতর্ক করে বলেছেন, ‘তোমরা কারও প্রতি জুলুম করো না।’ আল্লাহ পাকের ঘোষণা, ‘আল্লাহতায়ালা জুলুমকারীদের হেদায়েত দেন না।’ কারণ জালেমকে আল্লাহতায়ালা পছন্দ করেন না।
হজরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তিনটি বৈশিষ্ট্য যার মধ্যে থাকবে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে নিজ রহমতের ছায়াতলে আশ্রয় দেবেন এবং তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। তা হচ্ছে- ১. দুর্বলের সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করা, ২. মা-বাবার প্রতি উত্তম ব্যবহার করা ও ৩. অধীনস্থদের সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করা।
লেখার শুরুতে জুলুমের পরিচয় বলা হয়েছে। সেটা আরেকটু বিস্তারিতভাবে বলা যেতে পারে। জুলুম হচ্ছে, কারও বৈধ ইচ্ছার বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ, কারও অর্থ-সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করা কিংবা লুটে নেওয়া। এমনকি কোনো মুসলমান ভাইকে অন্যায়ভাবে আচার-আচরণে কষ্ট দেয়াও এক প্রকার জুলুম। উচ্চ পদ-পদবির লোক কর্তৃক নিচু পদের লোকদেরকে হেয়প্রতিপন্ন, কোনো কাজে অন্যায়ভাবে হস্তক্ষেপ, ক্ষমতার অপব্যবহার, ক্ষমতার জোরে যোগ্য ব্যক্তিকে অযোগ্য স্থানে নেওয়া আর অযোগ্য ব্যক্তিকে যোগ্য স্থানে নেওয়াও জুলুম।
যে সমাজে অধিক পরিমাণে জুলুম বিদ্যমান, সেখানে আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয় না। বরং বিভিন্ন আজাব-গজবে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আর যখন গজব আসে, তখন সব মানুষকেই তার পরিণাম ভুগতে হয়। মানুষজন এ বিষয়ে উদাসীন। মানুষকে এ বিষয়ে সাবধান হওয়া উচিত।
ইসলামি স্কলারদের মতে, সমাজে বিরাজমান অত্যাচার-অনাচার ও বিশৃঙ্খলা-অস্থিরতার মূল কারণ হলো- জুলুম। একে অপরের ওপর নানা রকম অবিচারের ফলে আল্লাহতায়ালা মানুষের ওপর এ বিশৃঙ্খলা চাপিয়ে দিয়েছেন। এ বিষয়ে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হচ্ছে, ‘জল ও স্থলভাগে যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে তা মানুষের কর্মের ফলস্বরূপ।’ –সূরা আর রুম: ৪১
হাদিসে বলা হয়েছে, মজলুম কিংবা নিপীড়িতের দোয়া কখনও ব্যর্থ হয় না। মজলুমের অশ্রুফোঁটা ও অন্তরের অভিশাপ পতনের অন্যতম কারণ। মজলুমের আর্তনাদের ফলে আল্লাহর পক্ষ থেকে জালেমদের ওপর নেমে আসে কঠিন আজাব। হাদিসে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তিন ব্যক্তির দোয়া আল্লাহর কাছ থেকে ফেরত আসে না। এক. ইফতারের সময় রোজাদারের দোয়া। দুই. ন্যায়পরায়ণ শাসকের দোয়া। তিন. মজলুমের দোয়া। আল্লাহতায়ালা তাদের দোয়া মেঘমালার ওপরে তুলে নেন এবং তার জন্য আসমানের দরজাগুলো খুলে দেন। মহান রব বলেন, আমার সম্মানের শপথ, কিছুটা বিলম্ব হলেও আমি তোমাকে অবশ্যই সাহায্য করব।’ –সুনানে তিরমিজি: ৩৫৯৮