মুমিনের জীবন হবে স্বচ্ছ্ব, সুন্দর ও নিষ্কলুষ। মুমিন যেমন প্রতারণা করে না, নিজেও প্রতারিত হয় না। প্রকৃত মুমিন কারও সম্পর্কে মন্দ ধারণা করে না। অন্যকেও নিজ সম্পর্কে কোরো ধরনের সন্দেহ কিংবা মন্দ ধারণা করার সুযোগ দেয় না। কখনও এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে ওই মুমিনের উচিৎ সন্দেহের অবসান ঘটানো। বিশেষত দ্বীনের দাঈ ও ধর্মপ্রচারকদের জন্য এটা অপরিহার্য। কারণ সবার কাছে বরণীয় ও গ্রহণযোগ্য না হলে দাওয়াতের কাজ করা কঠিন। তাই নিজেকে যাবতীয় সন্দেহের ঊর্ধ্বে রেখে জীবন যাপন করতে হবে।
হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, হজরত সাফিয়া বিনতে হুয়াই রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইতিকাফ অবস্থায় ছিলেন। আমি রাতের বেলা তার সঙ্গে সাক্ষাত করতে গেলাম। কিছু সময় হজরত রাসূলল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে কথা বললাম। তারপর ফিরে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালাম। তিনিও আমাকে বিদায় দেওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালেন। এমন সময় দু’জন আনসারি সাহাবি সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। তারা হজরত রাসূলুল্লাহকে (সা.) একজন নারীর সঙ্গে কথা বলতে দেখে দ্রুত স্থান ত্যাগ করতে থাকেন। তখন হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, তোমরা ধীরে চলো, এ কিন্তু আমার স্ত্রী সাফিয়া বিনতে হুয়াই। তারা দু’জন বলল, সুবহানাল্লাহ, ইয়া রাসূলাল্লাহ! (আমরা তো কিছু মনে করিনি)। তখন হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, শয়তান মানুষের শিরায় শিরায় চলে। আর আমি শংকিত হলাম এটা ভেবে যে, সে তোমাদের উভয়ের অন্তরে কোনো মন্দ ধারণা কিংবা সন্দেহ সৃষ্টি করতে পারে। -সহিহ মুসলিম: ৫৪৯২
বর্ণিত হাদিস থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজ স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছিলেন। কিন্তু সাহাবা দু’জন সেটা জানতেন না। শয়তান তাদের অন্তরে মন্দ ধারণা সৃষ্টি করতে পারে। তাই হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদের সংশয় সৃষ্টির পূর্বেই নিরসন করে দিলেন।
কোরআনে কারিম থেকেও আমরা এর দৃষ্টান্ত খুঁজে পাই। বিবরণটা এমন। মিসরের মন্ত্রীর স্ত্রী জুলায়খা হজরত ইউসুফ আলাইহিস সালামকে নিজের স্বী মনোবাসনা চরিতার্থ করার জন্য প্ররোচিত করেছিল। কিন্তু আল্লাহর নবী ইউসুফ আলাইহিস সালাম নিজেকে পূত-পবিত্র রাখলেন। এটা সবার কাছে স্পষ্ট ছিল। তার পরও পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য মিসরের বাদশা হজরত ইউসুফকে (আ.) কারাগারে প্রেরণ করলেন। বেশ কয়েকবছর তিনি কারাগারে কাটালেন। পরে হজরত ইউসুফ (আ.) মিসরের বাদশার দেখা স্বপ্নের ব্যাখ্যা-বিবরণ, দেশে ভবিষ্যত দুর্ভিক্ষের খবর ও তা থেকে পরিত্রাণের উপায়ের কথা জানান। বাদশা হজরত ইউসুফকে (আ.) জেল থেকে বের করার নির্দেশ দিলেন। বাদশার প্রতিনিধি কারাগারে হজরত ইউসুফকে (আ.) মুক্তির সংবাদ শোনালেন। কিন্তু তিনি মুক্তির আগে সৃষ্ট সংশয়ের স্পষ্ট নিরসন চাইলেন। অন্যদের অন্তরে যেন কোনো মন্দ ধারণা না জন্মায়, তাই বাদশার মাধ্যমে বিষয়টি নিষ্পত্তি কামনা করেন। হজরত ইউসুফ (আ.) বাদশার দূতকে বললেন, সে সব মহিলাদের বিষয়টি বাদশাকে স্পষ্ট করতে বলো। - তাফসিরে মায়ারেফুল কুরআন
এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘বাদশাহ বলল, ফিরে যাও তোমাদের প্রভুর কাছে এবং জিজ্ঞেস করো তাকে ওই মহিলার স্বরূপ কি, যারা স্বীয় হস্ত কর্তন করেছিল! আমার পালনকর্তা তো তাদের ছলনা সবই জানেন। বাদশাহ মহিলাদেরকে বললেন, তোমাদের হাল-হাকিকত কি, যখন তোমরা ইউসুফকে আত্মসংবরণ থেকে ফুসলিয়েছিলে? তারা বলল, আল্লাহ মহান, আমরা তার সম্পর্কে মন্দ কিছু জানি না। আজিজপত্মী বলল, এখন সত্য কথা প্রকাশ হয়ে গেছে। আমিই তাকে আত্মসংবরণ থেকে ফুসলিয়েছিলাম এবং সে সত্যবাদী।’ –সূরা ইউসুফ: ৫০-৫১
এ বিষয়ে হজরত ইমাম বোখারি রহমাতুল্লাহি আলাইহির একটি প্রসিদ্ধ ঘটনা আছে। ইমাম বোখারি (রহ.) হাদিস সংগ্রহ করার জন্য একবার নদীপথে সফরে ছিলেন। সঙ্গে ছিল এক হাজার দিনার (স্বর্ণমুদ্রা)। এক চোর কোনোভাবে দিনারগুলো দেখে ফেলে। পরে ওই চোর নৌকার অন্য যাত্রীদের সামনে ঘোষণা করে, তার এক হাজার দিনার চুরি হেয় গেছে। চোর দিনারের বিবরণও প্রদান করে। ইমাম বোখারি (রহ.) চোরের ঘোষণা শুনে অবাক হলেন। কারণ নির্দিষ্ট বিবরণের দিনারতো তার নিজের কাছে। দিনার উদ্ধারের জন্য একজন একজন করে যাত্রীদের তল্লাশি করা হচ্ছে। এমতাবস্থায় ইমাম বোখারি (রহ.) থলের দিনারগুলো পানিতে ফেলে দিলেন। এক পর্যায়ে ইমাম বোখারিকেও তল্লাশি করা হলো। কিন্তু অবাক, তার কাছে দিনার মিলল না। পরে চোর ইমাম বোখারিকে জিজ্ঞাসা করল, আপনি দিনারগুলো কি করেছেন? উত্তরে বললেন, আমি দিনারগুলো পানিতে ফেলে দিয়েছি। চোর আশ্চর্য হলো। ইমাম বোখারি (রহ.) তখন বললেন, দেখো! আমি একটি হাদিসের কিতাব লিখছি। মানুষ এ থেকে ইলম অর্জন করবে। আজ যদি আমার গায়ে চুরির অপবাদ লাগে, তবে মানুষের মনে আমার সম্পর্কে মন্দ ধারণা জন্মাবে। বলবে এটা একটি চোরের লিখিত কিতাব। সুতরাং আমি নিজেকে পরিচ্ছন রাখতে, অন্যদের মন্দ ধারণা দূর করার জন্য দিনারগুলো পানিতে ফেলে দিয়েছি। -সিরাতু ইমাম বোখারি লিলমুবারকপুরি: ১/১২২-২৩ পৃষ্ঠা।
পবিত্র কোরআন, রাসূলের হাদিস ও ইমাম বোখারি (রহ.)-এর ঘটনা থেকে আমরা শিক্ষাগ্রহণ করতে পারি। বিশেষ করে যারা ধর্ম প্রচারক, দ্বীনে দাঈ তারা। তাদেরকে সবসময় সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে রাখতে হবে। কোনো মন্দ ধারণা কিংবা সন্দেহ সৃষ্টি হয় এমন কোনো কথা-কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। কখনও কোনো অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে ওই বিষয়ে দ্রুত সন্দেহের নিরসন করবে।