সূরা তাগাবুন কোরআনে কারিমের ৬৪তম সূরা। মদিনায় নাজিল হওয়া এ সূরায় রয়েছে ১৮ আয়াত। আল্লাহতায়ালার একত্ববাদ, গুণাবলী, আকাশ ও ভূমণ্ডলের সৃষ্টি, মানুষের গোপন ও প্রকাশ্য কাজগুলোসহ সব বিষয়ে আল্লাহর অসীম জ্ঞান, অতীতের জাতিগুলোর ইতিহাস এবং পরকাল সূরা তাগাবুনের আলোচ্য বিষয়ের অন্যতম।
এছাড়া কিয়ামতের দিনে এক দল মানুষের সফল হওয়া ও অন্য দলের ব্যর্থ হওয়া, আল্লাহ ও তার নবীর প্রতি আনুগত্য, ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির প্রতি মোহাবিষ্ট না হওয়া এবং দান-খয়রাতের গুরুত্ব নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে এ সূরায়।
সূরা তাগাবুনের প্রথমে ইরশাদ হচ্ছে, ‘নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলে যা কিছু আছে, সবই আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করে। রাজত্ব তারই এবং প্রশংসাও তারই। তিনি সব বিষয়ে সর্বশক্তিমান।’
উল্লেখিত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইসলামি স্কলাররা বলেছেন, আল্লাহতায়ালা বিশ্বজগতের সবকিছুর মালিক ও সবকিছুর ওপর কর্তৃত্বশীল। তার নির্দেশ সবকিছুর ওপর কার্যকর হয়, সব প্রশংসা আল্লাহরই প্রশংসা। কারণ সব অস্তিত্বের স্রষ্টা ও মূল উৎস তিনিই। কাজেই সবকিছুর সূচনা ও সমাপ্তি তার হাতে, তার শক্তি সীমাহীন।
বস্তুত আল্লাহতায়ালা মানুষকে সৃষ্টি করা ছাড়াও তাকে দিয়েছেন পছন্দ করার স্বাধীনতা। তাই কেউ কেউ আল্লাহ ও তার নিদর্শনগুলোকে বিশ্বাস করে। অন্যদিকে অনেকেই খোদায়ী পরীক্ষার বিধানকে অপব্যবহার করে অবিশ্বাসী হয়। আল্লাহ তাদের উভয়ের কার্যকলাপ দেখেন। আর এটাই হলো- সূরা তাগাবুনের দ্বিতীয় আয়াতের মূল বক্তব্য।
তৃতীয় আয়াতে আল্লাহপাক রাব্বুল আলামীন বলছেন, ‘তিনি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলকে যথাযথভাবে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদেরকে আকৃতি দান করেছেন, এরপর সুন্দর করেছেন তোমাদের আকৃতি। তারই কাছে ফিরে যাবে সব কিছ।’
পরম করুণাময় আল্লাহ সৃষ্টিজগত সৃষ্টি করেছেন বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। তাইতো বিশ্ব চরাচরে দেখা যায়, খোদায়ী নিয়মের নিখুঁত রাজত্ব। সর্বশক্তিমান ও সর্বশ্রেষ্ঠ আল্লাহ মানুষকে দিয়েছেন সুন্দর বাহ্যিক আকৃতি এবং তাদেরকে দিয়েছেন বিবেক ও বুদ্ধিমত্তা যা সুন্দর করে তাদের মনকে। সব সৃষ্টির মাঝে যা রয়েছে কেবল মানুষের মধ্যেই দিয়েছেন তার কিছু নমুনা। মোট কথা, আল্লাহ মানুষের কল্যাণের জন্য যা যা দরকার তার সবই তিনি তাদেরকে দিয়েছেন।
আসলে মানুষ হচ্ছে আল্লাহর সবচেয়ে সুন্দর সৃষ্টি। আর সব সৃষ্টিই ফিরে যাবে আল্লাহর কাছে। অথচ সবচেয়ে নিকৃষ্ট কিছু পর্যায় অতিক্রম করে যাত্রা শুরু করতে হয়েছে মানুষকে। মানুষের মহাযাত্রা হচ্ছে অসীমের দিকে, আল্লাহর সান্নিধ্য ও নৈকট্যের দিকে। এভাবে মানুষকে এক মহান লক্ষ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে বলে আল্লাহতায়ালা সব সময় মানুষকে সুরক্ষা দিচ্ছেন। তিনি মানুষের ভেতর ও বাইরের সব খবর রাখেন। বিষয়টি সূরা তাগাবুনের চতুর্থ এভাবে বলা হয়েছে, ‘নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলে যা আছে, তিনি তা জানেন। তিনি আরও জানেন তোমরা যা গোপনে করো এবং যা প্রকাশ্যে করো। আল্লাহ অন্তরের বিষয়াদি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত।’
এখানে তিন ধরনের জ্ঞানের কথা তুলে ধরা হয়েছে। প্রথমত তিনি আকাশ ও ভূমণ্ডলের সবকিছু সম্পর্কে জানেন। দ্বিতীয়ত তিনি মানুষের সব ধরনের গোপন ও প্রকাশ্য কাজ সম্পর্কে জানেন। তৃতীয়ত আল্লাহ মানুষের মনের গোপন বিশ্বাস, চিন্তাধারা ও ইচ্ছার প্রকৃতিসহ তাদের অন্তরের সবকিছুর খবর রাখেন।
এটা স্পষ্ট যে, আল্লাহতায়ালার ক্ষমতা ও জ্ঞান সম্পর্কিত এসব বাস্তবতা মানুষের শিক্ষা, সংস্কার ও আত্মশুদ্ধিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এসব বাস্তবতা সম্পর্কে ধারণা মানুষকে আল্লাহর সৃষ্টি জগত, সৃষ্টির লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে ও পরিপূর্ণতা অর্জনের পথে সক্রিয় হতে প্রস্তুত করে।
আমরা জানি, ইতিহাস চর্চা মানবজাতির শিক্ষার অন্যতম প্রধান মাধ্যম। তাই পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা তুলে ধরেছেন অতীতের জাতিগুলোর শিক্ষণীয় সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। যা সূরা তাগাবুনের পঞ্চম আয়াতে আল্লাহ বলছেন, ‘তোমাদের আগে যারা কাফের ছিল, তাদের কাহিনী কি তোমাদের কাছে পৌঁছেনি? তাদের কাজের শাস্তি আস্বাদন করেছে তারা এবং তাদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।’
আমরা জানি, অতীতের অনেক জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে আল্লাহ প্রেরিত নবী-রাসূলদের অস্বীকার করার কারণে। তারা এই কুফুরি করত অহংকারের কারণে। তারা বলত, আমাদের মতো মানুষই আমাদের পথ দেখাতে চায়? এ তো এক অসম্ভব বিষয়! এভাবে তারা কুফুরি করত। কিন্তু আল্লাহতায়ালা তাদের আনুগত্য ও ঈমানের মুখাপেক্ষী নন।
সূরা তাগাবুনের ষষ্ঠ আয়াতে এ ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে, সারা বিশ্বের সব সৃষ্টিও যদি কাফের হয়ে যায় তাহলেও আল্লাহতায়ালার গৌরবময় মর্যাদার অশেষ উঁচু চূড়ায় বিন্দুমাত্রায় হেরফের হবে না, কিংবা তার মহামর্যাদার অশেষ ঔজ্জ্বল্যের একবিন্দুও ম্লান হবে না। বস্তুত মানুষই আল্লাহতায়ালার গঠনমূলক, উন্নয়নমূলক ও পূর্ণতাদায়ক নানা কর্মসূচির মুখাপেক্ষী।