মসজিদ মুসলমানদের ইবাদত-বন্দেগি এবং মানসিক প্রশান্তির স্থান। একজন মুসলমানের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে মসজিদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বেশিরভাগ মুসলমান প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে জামাতের সঙ্গে আদায় করেন। বিশ্বের এমন কোনো দেশ নেই যেখানে মসজিদ দেখতে পাওয়া যায় না। মুসলিম দেশ তো বটেই, অমুসলিম দেশেও মসজিদের অভাব নেই। লাখ লাখ মসজিদের মিনার থেকে প্রতিদিন উচ্চারিত হয় আজানের সুমধুর ধ্বনি।
মসজিদগুলোর মধ্যে কতগুলো সাধারণ মিল থাকলেও দেশ, পরিবেশ ও জনসংখ্যাভেদে মসজিদের আকার, আকৃতি, গঠনপ্রণালী, শৈল্পিক ও স্থাপত্যকলায় পরিলক্ষিত হয় নানা বৈচিত্র্য। আধুনিক যুগে মসজিদ নির্মাণের বেলায় আরও কতগুলো জরুরি বিষয় সামনে এসেছে। সময়ের চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে এর ব্যবস্থাপনা, ব্যয় নির্বাহে আসছে আধুনিকতা। বিশেষ করে প্রাকৃতিক পরিবেশের সুরক্ষা বিবেচনায় রেখে এখন ভিন্ন আঙ্গিকে তৈরি হচ্ছে মসজিদ।
আধুনিক বিশ্ব ভয়াবহ পরিবেশ দূষণের ভারে বিপর্যস্ত। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বে বেড়েছে দূষণ ও বংশগত পরিবর্তন। বৃদ্ধি পেয়েছে বৈশ্বিক উষ্ণতা। ফলে পরিবেশ দূষণের শিকার হচ্ছে অগণিত মানুষ, প্রাণী জাতি ও উদ্ভিদ। গ্রিন হাউস অ্যাফেক্টের কারণে মানবসভ্যতা একটি চরম অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত হচ্ছে।
ফলে পৃথিবীর দেশে দেশে পরিবেশবাদী মানুষ, চিন্তাশীল বিজ্ঞানী ও দার্শনিকরা পরিবেশ সংকট নিয়ে চরম উৎকণ্ঠার মধ্যে কাটাচ্ছেন এবং এই সংকট উত্তরণের উপায় উদ্ভাবনের নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। পরিবেশ দূষণের করালগ্রাস থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য দেশে দেশে বনায়ন ও সবুজায়নসহ কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনা এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য চলছে নানা উদ্যোগ। তৈরি হচ্ছে পরিবেশবান্ধব মিল-কারখানা, অফিস-বাড়ি। পণ্যসামগ্রীর মোড়ক পরিবেশসহনীয় করার জন্যও নেওয়া হচ্ছে কৌশল। এই লক্ষ্য সামনে রেখেই অনেক দেশ পরিবেশবান্ধব মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নিচ্ছে।
‘পরিবেশবান্ধব’ কথা দ্বারা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নয় এমন অবস্থাকে বোঝায়। অতএব, পরিবেশবান্ধব মসজিদের অবকাঠামো এবং গঠনপ্রণালী এমন হবে, যা মুসল্লিদের সর্বোচ্চ পরিবেশগত উপকার সাধনে সক্ষম।
পরিবেশবান্ধব ধারণার বাস্তব প্রয়োগ হলো, কার্যক্ষেত্রে স্বল্প পরিমাণ শক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা, শক্তির অপচয় রোধ করা, নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপন্ন, কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনা, সবুজ বনায়ন এবং পানির পুনঃব্যবহারের কৌশল অবলম্বন করা। অর্থাৎ প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যয় ও অপচয় রোধ করে কম সম্পদে সর্বোচ্চ উপকার আদায় নিশ্চিত করা।
মহান আল্লাহ এবং ইসলামের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পানি, বাতাস, সূর্যের আলোসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ সতর্কভাবে ব্যবহার এবং এগুলোর অপব্যয় এবং অপচয় রোধ করার তাগিদ দিয়েছেন। আর এই মহৎ উদ্দেশ্য সামনে রেখেই পরিবেশবান্ধব মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ।
পরিবেশবান্ধব মসজিদের ধারণা নতুন কিছু নয়। আল্লাহর রাসুল (সা.) নির্মিত মদিনার মসজিদে নববী পরিবেশবান্ধব মসজিদের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বর্তমানে মুসলিম বিশ্বের কয়েকটি দেশ পরিবেশবান্ধব মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
কারণ মসজিদের সঙ্গে মুসলমানদের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। মুসল্লিরা দিন ও রাতে অন্তত দেড় থেকে দুই ঘণ্টা মসজিদে নামাজ ও জিকির-আজকারে সময় কাটান। কেউ কেউ আরও বেশি সময় নামাজ ও অন্যান্য ইবাদতে মসজিদে অবস্থান করেন। নিবিড় ও একনিষ্ঠভাবে মহান আল্লাহর ইবাদত করার সর্বোত্তম স্থান হলো- মসজিদ। তাই এর পরিবেশ ও ব্যবস্থাপনা হওয়া চাই সবচেয়ে বেশি উন্নত এবং অবশ্যই পরিবেশবান্ধব। এখানে হাজার হাজার মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ পড়েন। ফলে মসজিদে দরকার হয় প্রচুর পানি, বিদ্যুৎ এবং যথেষ্ট শব্দসঞ্চালন ব্যবস্থা। বিপুলসংখ্যক মানুষের কাছে ইমামের খুতবা, কোরআন তেলাওয়াত পৌঁছানোর জন্য উন্নত শব্দসঞ্চালন ব্যবস্থা খুবই জরুরি।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, অজু ইবাদতের অত্যাবশ্যকীয় অংশ। মসজিদে বিপুলসংখ্যক মুসল্লির অজুর জন্য প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়। তাই মসজিদ এমনভাবে তৈরি করা হবে, যেখানে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা যায় এবং অজুর পানি পুনর্ব্যবহার করে অন্যান্য কাজে লাগানো যায়। কেননা, বিশুদ্ধ পানির অভাব বর্তমান পৃথিবীর একটি প্রকট সংকটে পরিণত হয়েছে। পানি আল্লাহর একটি বড় নেয়ামত। তাই পানির সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত এবং এর অপচয় রোধ খুবই প্রয়োজন। আল্লাহ পানিকে তার একটি নেয়ামত বলে ঘোষণা করেছেন। সুরা ওয়াকিয়ার ৬৮ ও ৬৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা যে পানি পান করো সে সম্পর্কে ভেবে দেখেছ কি? বৃষ্টিভরা মেঘ থেকে তোমরা কি তা বর্ষণ করো, না আমি বৃষ্টি বর্ষণকারী?’
পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে মানবজীবনে পানির গুরুত্ব ও অবদান সম্পর্কে মহান আল্লাহ জোর দিয়েছেন। তাই মসজিদে পানির অপচয় রোধে পুনর্ব্যবহারযোগ্য ব্যবস্থার প্রবর্তন করা খুবই জরুরি। অজুর পানি ব্যবহারের পর এই পানি আমরা মসজিদ এলাকার বাগানের গাছপালার পরিচর্যায় ব্যবহার করতে পারি।
পরিবেশবান্ধব মসজিদের অন্যতম একটি উপাদান হলো- বাগান। বাগানের গাছপালা ছায়া দিয়ে পরিবেশকে শুধু শীতলই রাখে না, শরীর সুস্থ রাখার জন্য প্রচুর অক্সিজেন সরবরাহ করে। বাগানের গাছে পাখি ও অন্যান্য কীটপতঙ্গ আশ্রয় তৈরি করে। তাই বাগান নির্মল পরিবেশের জন্য যেমন প্রয়োজন, তেমনি ইসলামি মূল্যবোধ ও ঐতিহ্য ধারণের উদ্দেশ্যে বাগানের বিশেষত্ব রয়েছে। বাগান সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের সুরা তওবার ৭২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ মুমিন পুরুষ ও নারীদের জান্নাতের (বাগান) ওয়াদা দিয়েছেন, যার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হবে নহরসমূহ, তাতে তারা চিরদিন থাকবে।’
সুরা আন-নিসার ১৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আর যে আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্য করে আল্লাহ তাকে প্রবেশ করাবেন জান্নাতসমূহে (বাগান), যার তলদেশে প্রবাহিত রয়েছে নহরসমূহ।’ আল্লাহর রাসুল (সা.) ও বিষয়টির প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন, ‘যদি কোনো মুসলমান একটি গাছ লাগায়, তাতে ফল ধরে এবং এই ফল কোনো মানুষ বা পাখি খায়, তা হলে এটি তার জন্য সাদকা হিসেবে গণ্য হবে।’ –সহিহ বোখারি
এসব কারণে পরিবেশবান্ধব মসজিদের ধারণা এখন বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। পরিবেশবান্ধব মসজিদগুলোতে প্রাকৃতিক আলো ও বায়ু চলাচলব্যবস্থা থাকায় শীতাতপ, পাখা ও আলোর বাতির প্রয়োজন অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। মসজিদে স্থাপিত সোলার ব্যবস্থার ফলে বিদ্যুতেরও সাশ্রয় হচ্ছে। ফলে বর্তমান বিশ্বে পরিবেশ দূষণের যে সংকট চলছে পরিবেশবান্ধব মসজিদগুলো সেখানে দর্শনীয় অবদানও রাখছে।