একজন মুসলিম হিসেবে আমরা নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করি। অনেক সময় না-জানা কিংবা অবহেলার কারণে নামাজে বিভিন্ন ধরনের ভুল হয়। সেসব ভুলের দরুণ কখনও নামাজ মাকরূহ হয়ে যায়, আবার কখনও নামাজই হয় না; নষ্ট হয়ে যায়। তাই এখানে বহুল প্রচলিত কতিপয় ভুল-ভ্রান্তি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
তাকবিরে তাহরিমা মনে মনে বলা
অনেকে নামাজের শুরুতে উভয় হাত কান পর্যন্ত উঠিয়ে হাত বাঁধাকেই তাকবিরে তাহরিমা মনে করে। ফলে তারা আর মুখে তাকবির উচ্চারণ করে না। এটি একটি মারাত্মক ভুল। এর দ্বারা নামাজ সহিহ হয় না। কারণ নামাজের শুরুতে স্পষ্ট উচ্চারণে তাকবির তথা ‘আল্লাহু আকবার’ বলা ফরজ। যেহেতু এই তাকবিরের মাধ্যমে নামাজ বহির্ভূত সব কাজ হারাম হয়ে যায় তাই একে ‘তাকবিরে তাহরিমা’ বলা হয়। এই তাকবির স্পষ্টভাবে মুখে উচ্চারণ করে বলা ফরজ।
সুতরাং কেউ যদি শুধু দুই হাত উঠিয়ে নাভির নিচে বেঁধে নেয়; কিন্তু মুখে ‘আল্লাহু আকবার’ না বলে বা মনে মনে বলে তাহলে তার নামাজের প্রথম ফরজ আদায় না হওয়ার কারণে তার নামাজ সহিহ হবে না। অতএব তাকবির স্পষ্টভাবে মুখে উচ্চারণ করতে হবে। শুধু মনে মনে বলা যথেষ্ট হবে না। -মারাকিল ফালাহ : ২১৮
ইমামের আগে তাকবিরে তাহরিমা শেষ করে ফেলা
অনেক মুসল্লিকে দেখা যায়, তারা ইমামের সঙ্গে তাকবিরে উলা ধরার জন্য একেবারে ইমামের সঙ্গে সঙ্গেই তাকবিরে তাহরিমা বলে। এক্ষেত্রে অসতর্কতার দরুণ কখনও কখনও মুক্তাদির নামাজ অশুদ্ধ হয়ে যায়। কেননা মুক্তাদির নামাজ শুদ্ধ হওয়ার জন্য তার তাকবিরে তাহরিমা, ইমামের তাকবিরে তাহরিমা বলে শেষ করার পরে শেষ হওয়া জরুরি। ইমামের তাকবিরে তাহরিমা শেষ হওয়ার আগেই যদি মুক্তাদির তাকবির বলা শেষ হয়ে যায় তাহলে তার ইক্তেদা ও নামাজ সহিহ হবে না।
অনেক সময় ইমাম সাহেবের তাকবিরে তাহরিমা দীর্ঘ করে টেনে বলার কারণে মুক্তাদির তাকবির তার আগে শেষ হয়ে যায়। ফলে মুক্তাদির নামাজ শুদ্ধ হয় না। অতএব মুক্তাদিদের এ ভুল থেকে বাঁচানোর জন্য ইমামের কর্তব্য হলো, তাকবিরে তাহরিমার ‘আল্লাহ’ শব্দের লামকে এক আলিফের চেয়ে বেশি দীর্ঘ না করা। -আদ দুররুল মুখতার : ১/৪৮০
আল্লাহু আকবারের ‘হামজা’ অথবা ‘বা’ কে টেনে পড়া
কোনো কোনো মুসল্লি ও ইমামকে নামাজের মধ্যে তাকবির বলার সময় ‘আল্লাহু আকবার’-এর (বা) টেনে পড়তে শোনা যায়। এটা একটা বড় ভুল। কারণ (বা) এ ‘মদ’ করলে অর্থাৎ টেনে দীর্ঘ করে পড়লে তার অর্থে চরম বিকৃতি ঘটে। বিনা মদে ‘আকবার’ অর্থ ‘সবচেয়ে বড়’। আর মদ সহকারে ‘আকবা-র’ শয়তানের বাচ্চার নাম। এ ভুলটি যদি তাকবিরে তাহরিমার মধ্যে হয় তাহলে নামাজ আরম্ভই হবে না। আর নামাজের ভেতরের কোনো তাকবিরে হলে নামাজ নষ্ট হয়ে যাবে। তদ্রূপ ‘আল্লাহু আকবার’ এর প্রথম অথবা দ্বিতীয় ‘আ’-কে টেনে দীর্ঘ করে পড়লে নামাজ ভেঙ্গে যাবে। কেননা সেক্ষেত্রেও তাকবিরের অর্থ ও মর্ম ভীষণভাবে পাল্টে যায়। সেক্ষেত্রে তা প্রশ্নবোধক বাক্যে পরিণত হয়, যা আল্লাহতায়ালার বড়ত্ব ও মহত্ত্বে সংশয় প্রকাশ করে। -মারাকিল ফালাহ : ২২৩
মনে মনে কেরাত পড়া
যে সব নামাজে আস্তে কেরাত পড়া হয়, সেসব নামাজে অনেককে দেখা যায়, তারা মুখ-ঠোঁট না নেড়ে মনে মনে সুরা-কেরাত পড়েন। তারা হয়তো মনে করেন, আস্তে কেরাত পড়া মানে মনে মনে পড়া। এই ধারণা ঠিক নয়। কারণ নামাজে কেরাত আস্তে পড়ার অর্থ হলো- নিচু স্বরে তেলাওয়াত করা। আর মনে মনে পড়া কোনোক্রমেই নিম্নস্বরে পড়া নয়।
আস্তে কেরাত পড়ার সর্বোত্তম পদ্ধতি হলো- এমনভাবে পড়া, যেন পাঠকারী নিজে শুনতে পায়। আর সর্বনিম্ন এতটুকু তো অবশ্যই জরুরি যে, সহিহ-শুদ্ধভাবে হরফ উচ্চারণ করা হবে এবং ঠোঁট-জিহবার নড়াচড়া দেখা যাবে। হাদিস শরিফে আছে, জোহর ও আসর নামাজে হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কেরাত পড়তেন, তখন কোনো কোনো আয়াত সাহাবায়ে কেরামও কখনও কখনও শুনতে পেতেন।
হজরত আবু কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জোহর ও আসর নামাজের প্রথম দুই রাকাতে সুরা ফাতেহার সঙ্গে আরেকটি সুরা পড়তেন। কখনও কোনো কোনো আয়াত আমাদের শুনিয়ে পড়তেন।’ –সহিহ বোখারি : ৭৭৮
অতএব কেরাত পড়ার সময় জিহবা ও ঠোঁট ব্যবহার করে মাখরাজ থেকে সহিহ-শুদ্ধভাবে হরফ উচ্চারণ করতে হবে। অন্যথায় শুধু মনে মনে পড়ার দ্বারা কেরাত আদায় হবে না এবং নামাজও সহিহ হবে না। -মারাকিল ফালাহ : ২১৯
রুকুতে গিয়ে তাকবিরে তাহরিমা বলা শেষ করা
অনেকে জামাতে ইমামকে রুকু অবস্থায় পেলে রাকাত ধরার জন্য দ্রুত রুকুতে চলে যায়। এ ক্ষেত্রে অনেকেই তাকবিরে তাহরিমা রুকুতে গিয়ে বলে। আবার অনেকে পূর্ণ তাকবির রুকুতে গিয়ে না বললেও দাঁড়িয়ে তাকবির শুরু করে, কিন্তু শেষ করে রুকুতে গিয়ে। অর্থাৎ দাঁড়ানো অবস্থায় ‘আল্লাহু’ বলে আর রুকু অবস্থায় গিয়ে ‘আকবার’ বলে। এটা একটা বড় ভুল। এভাবে তাকবিরে তাহরিমা বললে নামাজ হবে না। বরং পুরো তাকবিরে তাহরিমা দাঁড়িয়ে বলা জরুরি। পূর্ণ তাকবির কিংবা তাকবিরের কিছু অংশও যদি রুকুতে গিয়ে (অর্থাৎ হাত হাঁটু পর্যন্ত পৌঁছার পর) বা তার কাছাকাছি গিয়ে শেষ হয় তাহলে নামাজ হবে না। অবশ্য দাঁড়ানোর কাছাকাছি থাকা অবস্থায় পূর্ণ তাকবিরে তাহরিমা বলা শেষ করলেও নামাজ হয়ে যাবে।
অতএব তাকবিরে তাহরিমা পুরোটাই দাঁড়ানো বা দাঁড়ানোর কাছাকাছি অবস্থার ভেতর বলে শেষ করতে হবে। -খুলাসাতুল ফাতাওয়া : ১/৮৪
ইমামের রুকু থেকে উঠার পর রুকুতে যাওয়া
কোনো কোনো সময় এমন হয় যে, জামাত চলাকালীন আগন্তুক মুসল্লি তাকবিরে তাহরিমা বলে রুকুতে যাচ্ছে আর এদিকে ইমাম ‘সামিয়াল্লাহ’ বলে রুকু থেকে উঠে গেছেন। এক্ষেত্রে উক্ত মুসল্লি ইমামের সঙ্গে রুকু না পাওয়ার কারণে ওই রাকাত পায়নি। কেননা রাকাত পাওয়ার জন্য ইমামের সঙ্গে রুকু পাওয়া জরুরি। আর রুকু পাওয়ার জন্য এক মুহূর্তের জন্য হলেও ইমামের সঙ্গে রুকুতে শরিক হওয়া আবশ্যক। যদি কেউ ইমামকে রুকু অবস্থায় এক মুহূর্তের জন্যও না পায়; বরং ইমামের রুকু থেকে উঠে যাওয়ার পর, অর্থাৎ তার মাথা এবং হাঁটু থেকে হাত উঠে যাওয়ার পর রুকুতে যায় তাহলে সে ওই রাকাত পেয়েছে বলে ধর্তব্য হবে না।
অনেক মুসল্লি ইমামের রুকু থেকে উঠে যাওয়ার পর রুকুতে গিয়ে সেই রাকাত পেয়েছে বলে ধারণা করে এবং এক রাকাত কম আদায় করে। এতে তার নামাজ হয় না।
মুসল্লিদের এই মারাত্মক ভুল থেকে রক্ষার জন্য ইমামদের উচিত হলো, রুকু থেকে উঠা আরম্ভ করতেই তাকবির বলা শুরু করা। কেননা কোনো কোনো ইমাম সাহেব রুকু থেকে উঠার সময় কিছুদূর উঠার পর তাকবির বলেন। ফলে নবাগত মুসল্লি দূর থেকে মুসল্লিদেরকে রুকু অবস্থায় দেখে তাকবিরে তাহরিমা বলে রুকুতে যায়। অথচ তখন ইমাম সাহেব রুকু অবস্থায় নেই। এতে সে ইমামের সঙ্গে রুকু পেয়েছে মনে করে সে হিসেবে নামাজ পড়ার দরুণ তার নামাজ বাতিল হয়ে যায়। -ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ১/১২০
প্রথম সালামের পর ইমামের ইক্তেদা করা
অনেককে দেখা যায়, শেষ বৈঠকে যখন ইমাম সাহেব ডানদিকে সালাম ফিরিয়ে ফেলেন তখনও তারা তার ইক্তেদা করেন। এটাও ঠিক নয়। কারণ প্রথম সালামের ‘আসসালামু’ শব্দটি বলার সঙ্গে সঙ্গেই ইমামের ইক্তেদার সময় শেষ হয়ে যায়। এরপর আর ইমামের ইক্তেদা করা সহিহ নয়। সুতরাং এ অবস্থায় মুসল্লি ইমামের ইক্তেদা করলে তার নামাজ আদায় হবে না। -হাশিয়াতুত তাহতাবি আলাল মারাকি : ২৫১