‘যদি সেই সময় জনপদের মানুষগুলো ঈমান আনতো এবং তাকওয়া অবলম্বন করতো, তাহলে আমি তাদের ওপর আসমান ও জমিনের যাবতীয় বরকতের দুয়ার খুলে দিতাম, কিন্তু তারা তা প্রত্যাখ্যান করেছে, অতঃপর তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য আমি তাদের পাকড়াও করেছি।’ -সুরা আল আরাফ : ৯৬
বর্ণিত আয়াতের তাফসিরে বলা হয়েছে, ঈমান আনা ও তাকওয়ার নীতি অবলম্বন করলে আল্লাহ পাক বরকতের দুয়ার খুলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক করে দিয়েছেন। আল্লাহর এই ওয়াদা চিরন্তন। অর্থাৎ ঈমান ও তাকওয়া অবলম্বনকারীদের আল্লাহ বরকতের দুয়ার খুলে দেবেন। এ জন্য আয়াতে উল্লেখিত আল্লাহ নির্ধারিত দু’টি শর্ত পূরণ করতে হবে।
বস্তুত দুনিয়ার জীবনে বরকত ও কল্যাণ লাভের জন্য আল্লাহ দু’টি শর্ত প্রদান করেছেন। আল্লাহ প্রদত্ত সাফল্য বহুমাত্রিক এবং সেটি দুনিয়া ও আখিরাতে পাওয়া যাবে। সকল ধনভাণ্ডার ও কল্যাণের চাবিকাঠি আল্লাহর হাতে এবং তিনি তার বান্দাদের দিতে চান। শর্ত দু’টির প্রথম হলো- ঈমান এবং দ্বিতীয়টি হলো- তাকওয়া। জীবনে সত্যিকার সুখ-শান্তি-পরিতৃপ্তি দানের মালিক আল্লাহ এবং সেটি যথার্থ ভোগ করতে পারে কেবল মুমিনরা। প্রাচুর্যের মধ্যে যে প্রকৃত সুখ নেই, তা আমরা প্রতিনিয়তই চারপাশে লক্ষ করছি। আল্লাহর প্রতি ঈমান এবং তার পথে চলার মধ্যে যে পরিতৃপ্তি ও পরম সুখ রয়েছে তা কাফের-মুশরেকরা কখনও উপলব্ধি করতে পারে না। এখানে আল্লাহতায়ালা স্পষ্ট করেছেন, তার প্রতি ঈমান এবং তাকে ভয় করে চলার নীতি অবলম্বন করলে সেই জনপদকে তিনি সুখ-শান্তিতে ভরে দেবেন।
প্রশ্ন উঠতে পারে শতকরা নব্বইভাগ মুসলিম অধ্যুষিত আমাদের বাংলাদেশ এবং সমগ্র মুসলিম বিশ্বে প্রকৃত সুখ-শান্তি কি রয়েছে? এক কথায় জবাব হবে, না। আবার আমাদের মধ্যে একজনকেও পাওয়া যাবে না, যে বলতে পারে আল্লাহর ওয়াদা সঠিক নয়। তাহলে বলা যায় জাতিগতভাবে আমরা না মুমিন আর না মুত্তাকি। আমাদের কথাবার্তা, আচার-আচরণ, লেনদেন, ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত, কোর্ট-কাচারি কোথাও তাকওয়ার লেশ নেই। আমাদের মতো এতো মিথ্যাবাদী, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী, আমানতে খেয়ানতকারী, হিংসা-বিদ্বেষে জর্জরিত বিশ্বে বিরল। যার ফলে আল্লাহর প্রতিশ্রুত লাঞ্ছনা ও অপমান আমরা ভোগ করছি।
মনে হতে পারে, আমরা তো আধা মুসলমান কিন্তু যারা আল্লাহকে আদৌ মানে না, তাদের কেন আমাদের ওপর শাসন করার ক্ষমতা দান করেছেন। এটিই তো আমাদের শাস্তি-লাঞ্ছনা, অপমান ও জিল্লতি।
এই বিশ্ব পরিচালনার ক্ষেত্রে আল্লাহর একটি নিয়ম রয়েছে। যারা মৌলিক মানবীয় গুণে ভূষিত অর্থাৎ যাদের মধ্যে রয়েছে সততা, বিশ্বস্ততা, আমানতদারিতা, সুশাসন, ন্যায়পরায়ণতা, কল্যাণকামিতা, পরিশ্রমপ্রিয়তা, আল্লাহ তাদের দুনিয়ায় নেতৃত্ব দেবেন এবং ঈমান না থাকার কারণে আখেরাতে শুভ ফল লাভ থেকে তারা বঞ্চিত হবে। আল্লাহ কারও আমল বিনষ্ট করেন না। আল্লাহ পাক যখন এই আয়াত নাজিল করেন, তখন প্রতিশ্রুতি প্রদানের সঙ্গে পাকড়াও করার কথাও বলেছেন। অল্পদিনের ব্যবধানে আল্লাহ পাক আরবের জাহেলি নেতৃত্ব উৎখাত করে সেখানে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।
এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা উল্লেখ করা যাতে পারে। যা ছিল প্রিয়তম নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনে ঘটে যাওয়া মুজেজা। একটি ঘটনা খন্দকের যুদ্ধকালীন যখন মুসলমানরা চরম দুর্ভিক্ষে পতিত হন। শত্রু কর্তৃক অবরুদ্ধ হয়ে পড়ায় তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য সব বন্ধ হয়ে যায় এবং ক্ষুধায় তারা কাতর হয়ে পড়েন। এমন সময় হজরত জাবের (রা.) তার স্ত্রীকে এসে জানান যে, মুহাম্মদ (সা.) ও তার সাহাবিরা অভুক্ত রয়েছেন। এ কথা শুনে তার স্ত্রী বলেন, তাদের একটি ছাগল রয়েছে সেটি জবেহ করে দিয়ে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে দাওয়াত দিন। হজরত জাবের (রা.) হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জানালে তিনি প্রকাশ্য ঘোষণা করে দেন যে, সবার আজ জাবেরের বাড়িতে দাওয়াত। হজরত জাবের (রা.) ভয় পেয়ে স্ত্রীকে গিয়ে বললে তিনি জবাব দেন, যেহেতু হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, সেহেতু কোনো ভয় নেই বা সমস্যা নেই। এমনই ছিল আল্লাহর প্রতি তাদের তাওয়াক্কুল ও রাসুল (সা.)-এর প্রতি আস্থা। সেই রুটি ও গোশত যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবিরা খাওয়ার পরেও মদিনাবাসী তৃপ্তির সঙ্গে খেয়েছিলেন।
প্রসঙ্গত আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.)-এর বর্ণনা। তিনি আসহাবে সুফফার একজন সদস্য এবং সর্বাধিক হাদিস বর্ণনাকারী। একদিন তিনি ক্ষুধায় খুব কাতর হয়ে পড়লে হজরত আবু বকর (রা.) ও হজরত ওমর (রা.)-এর বাড়ি পর্যন্ত আলাপ করতে করতে যান। কিন্তু তারা কেউ তার অসহায়ত্ব উপলব্ধি করতে পারেননি। ফলে ফিরে মসজিদে চলে আসেন। নবী কারিম (সা.) বিষয়টি উপলব্ধি করে তাকে সঙ্গে করে বাড়ি নিয়ে যান। কোনো এক স্ত্রীর ঘরে এক পেয়ালা দুধ পান। দুধ নিয়ে মুহাম্মদ (সা.) হজরত আবু হুরায়রা (রা.) কে বলেন, আসহাবে সুফফার সবাইকে ডেকে আনো। দুধ এক পেয়ালা আর মানুষ সত্তর জন, তিনি তাজ্জব হয়ে যান। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) ছিলেন খুবই ক্ষুধার্ত। তিনি ভাবলেন, এক ফোঁটা করে দুধও তো ভাগে পড়বে না। সবাই উপস্থিত হলে তাকেই দেওয়া হয় দুধ পান করানোর দায়িত্ব এবং সবাই তৃপ্তির সঙ্গে সেই দুধ পান করেন। বরকত দানের মালিক আল্লাহ। তার ভাণ্ডার অফুরন্ত। এটি ছিল নবী কারিম (সা.)-এর প্রতি আল্লাহ পাকের অনুগ্রহ। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনে এমন অনেক মুজেজা ঘটেছে।
উপরোক্ত ঘটনা দু’টি আল্লাহর প্রত্যক্ষ বরকত দানের উদাহরণ। সূরা আরাফের ৯৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা সাধারণভাবে প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছেন, যেকোনো জনপদের মানুষ যদি তার প্রতি ঈমান আনে ও তাকে ভয় করে চলে তাহলে আল্লাহ তাদের জীবন থেকে দুঃখ-কষ্ট দূর করে আসমান ও জমিনের বরকতের দুয়ারসমূহ খুলে দেবেন। অন্যথা ঘটলে তারা আল্লাহর আজাবের মুখোমুখি হবে। আল্লাহ পাক আমাদের তার প্রতি ঈমান ও সকল অবস্থায় তাকে ভয় করে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন।