১২ রবিউল আউয়াল। মানব জাতির মহোত্তম পথপ্রদর্শক, নবীকুল শ্রেষ্ঠ হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম ও ওফাত দিবস। আজ থেকে প্রায় ১৫শ’ বছর আগে বিশ্বের কেন্দ্রভূমি পবিত্র মক্কা নগরীতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। নবী করিম (সা.) কেবল তার অনুসারীদেরই নন, জাতি-ধর্ম-বর্ণর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সব মানুষের আদর্শ ও পথপ্রদর্শক।
কোরআনে কারিমে এ বিষয়ে ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনাকে আমি জগৎসমূহের জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি।’ নবী করিম (সা.) বিশ্বমানবের আল্লাহ নির্ধারিত সেরা পথপ্রদর্শক, মহান শিক্ষক ও অনুপম আদর্শ। মানবেতিহাসের এক যুগসন্ধিকালে, অন্ধকারতম সময়ে তিনি আল্লাহতায়ালার বাণী নিয়ে অবতীর্ণ হন। তার উদাত্ত আহ্বান, নিষ্ঠাপূর্ণ কর্মসাধনা, উচ্চতম নীতি আদর্শ ও অমলিন পবিত্র-মাধুর্যের মাধ্যমে তিনি অতি অল্প দিনে এক আলোকোজ্জ্বল ও সর্বোন্নত জীবনব্যবস্থা বাস্তবায়ন করেন। অজ্ঞানতা, কুসংস্কার এবং অনাচার, পাপাচার ও বিশ্বাসহীনতার কলুষ দূরীভূত করে শান্তি, সভ্যতা, নিরাপত্তা ও মানবিক মর্যাদার এক নতুন পথ রচনা করেন। বিশ্বাস, প্রজ্ঞা ও মানবিক গুণাবলী সমৃদ্ধ নয়া সভ্যতার স্থপতি হিসেবে তিনি কেবল আরব জন্মভূমি নয়, গোটা বিশ্বের মুক্তির দিশা দান করেন।
আল্লাহর একমাত্র মনোনীত ধর্ম ইসলামের বাণী বাহক হিসেবে তিনি মানুষের ধর্মীয় জীবনেই প্রভাব বিস্তার ও সুনির্দিষ্ট করেননি বরং মানব জীবনের এমন কোনো দিক বিভাগ পাওয়া যাবে না যেখানে তার অনিবার্য প্রভাব প্রতিফলিত হয়নি। তিনি একাধারে একটি ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা, একটি জাতির নির্মাতা এবং একটি অতুল্য সভ্যতার স্রষ্টা। তাই তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ নবী, সাইয়েদুল মুরসালিন ও খাতামুন্নাবিয়ীন।
তার যখন আবির্ভাব হয়, তখন পবিত্র মক্কা নগরীসহ সমগ্র আরব জাহেলিয়াতের মধ্যে নিমজ্জিত ছিল, পৌত্তলিকতা, যুদ্ধ, বিরোধ, হানাহানি, অবিশ্বাস, সামাজিক অনাচার, কুসংস্কার, বৈষম্য, মানবিক অধঃপতন মারাত্মক পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল। তিনি অবনত অধঃপতিত মানব গোষ্ঠীকে অল্প দিনের ব্যবধানে সৎ, সত্যনিষ্ঠ, দায়িত্বশীল, মানবিক ও তাওহিদ বিশ্বাসী জাতিতে রূপান্তর করেন। তিনি কেবল আল্লাহতায়ালার সর্বশেষ কিতাব কোরআনে কারিমের গ্রাহক, ধারক ও বাস্তবায়নকারীই নন, তার গোটা জীবনটি ছিল পবিত্র কোরআনের প্রতিরূপ। বিশ্বমানবের মুক্তি, শান্তি, ইহ-পরকালীন মঙ্গল, বিকাশ, নিরাপত্তা- সবকিছুই আসতে পারে পবিত্র কোরআন ও তার জীবনকর্ম অনুসরণ করার মাধ্যমে।
বিদায় হজের ভাষণে তিনি বলেছেন, আমি দু’টি বিষয় রেখে গেলাম। যতদিন এ দু’টি আঁকড়ে ধরে থাকবে, ততদিন তোমরা পথচ্যুত হবে না। এ দু’টি হলো- আল্লাহর কিতাব এবং আমার সুন্নাহ (হাদিস)।
নবী কমিম (সা.)-এর শিক্ষা, আদর্শ, পদাঙ্ক ও পথনির্দেশনা অনুসরণ করে গত প্রায় ১৫ শত বছর মুসলিম উম্মাহর অন্তর্গত মানুষ তাদের জীবন সাধনা চালিয়ে আসছে। এ সময়ে মুসলমানরা বহু ভুখণ্ড জয় করেছে, বহু সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছে, শাসনকার্য পরিচালনা করেছে। অতীতে দীর্ঘ সময় জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, দর্শন-শিক্ষা-সংস্কৃতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছে।
বর্তমান বিশ্বসভ্যতা সবচেয়ে বেশি ঋণী ইসলাম ও মুসলমানদের কাছে। এ সভ্যতার যা কিছু সুন্দর, যা কিছু কল্যাণকর, যা কিছু মঙ্গলজনক তার পেছনে রয়েছে মহানবী (সা.)-এর আদর্শ, শিক্ষা, নির্দেশনার অনিবার্য ভূমিকা। শান্তি, নিরাপত্তা, মানবাধিকার ও মানবিক বিকাশের সব ক্ষেত্রে ইসলামের অবদান অনস্বীকার্য। বর্তমান বিশ্বে মানুষ যখন ধর্মবিমুখ বস্তুবাদী দর্শনের কবলে পড়ে যুদ্ধ-সংঘাত-সন্ত্রাস ও অশান্তির অনলে পুড়ছে, যখন ক্ষমতা, সম্পদ ও ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়ে নিজের সর্বনাশকে দ্রুত ডেকে আনছে; তখন একমাত্র ইসলাম ও বিশ্বনবী (সা.)-এর শিক্ষাই তাকে সর্বোত্তম সুরক্ষা দিতে পারে।
অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও স্বীকার করতে হচ্ছে, গোটা মুসলিম বিশ্ব এবং ব্যাপক অর্থে মুসলিম উম্মাহ এখন কঠিন সময় অতিক্রম করছে। বিশ্বের যেখানেই অশান্তি, যুদ্ধ-সংঘাত-সন্ত্রাস এবং মানবিক বিপর্যয় চলছে সেখানেই এসবের শিকার হচ্ছে প্রধানত মুসলমানেরা। এ জন্য ইসলামবিদ্বেষী ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভূমিকা যেমন দায়ী, তেমনি দায়ী মুসলিম উম্মাহর মধ্যকার অনৈক্য, বিভেদ, বিদ্বেষ এবং কোরআন ও নবী করিম (সা.)-এর সুন্নাহ যথাযথভাবে অনুসরণ না করা। এমন অবস্থা থেকে উঠে আসার পথ একটিই এবং সেটি হলো- কোরআন-সুন্নাহর একনিষ্ঠ ও আন্তরিক অনুসরণ।
আমরা জানি, বাংলাদেশেও মুসলিম জাতিসত্তা এবং ইসলামের বিরুদ্ধে নানা প্রকার অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্র চলছে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এদেশে ধর্মহীনতা, অনৈতিকতা ও অপসংস্কৃতি প্রশ্রয় পাচ্ছে। মানুষের খারাপ আচরণ ব্যাপকহারে বাড়ছে। ইসলামের দেখানো পথ থেকে মানুষ দিন দিন দূরে চলে যাচ্ছে।
তাই, আজকের এই দিনে আমরা বাংলাদেশসহ বিশ্ব মুসলিমের বিরুদ্ধে পরিচালিত অপপ্রচার, চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সতর্ক ও সচেতন হওয়ার আহবান জানাই। আহবান জানাই হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ ও শিক্ষা অনুসরণের মাধ্যমে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে উঠান। মনে রাখতে হবে, হই ও পরকালীন মুক্তি, কল্যাণ, সমৃদ্ধি, বিকাশ ও প্রতিষ্ঠার জন্য হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পদাঙ্ক অনুসরণের কোনো বিকল্প নেই।