মক্কা (সৌদি আরব) থেকে: কেউ কারো ভাষা জানে না। কখনো পরস্পরের দেখাও হয় নি। ইসলাম সবাইকে একাকার মিশিয়েছে বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের অটুট বন্ধনে। বুকের পিঞ্জর থেকে ভেসে ভেসে সকলের কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছে 'আল্লাহ', 'আল্লাহ' ধ্বনি।
বায়তুল্লাহর পবিত্র কাবা চত্বর মুখরিত হামদ ও ছানায়। মাতাফ বা তাওয়াফের প্রাঙ্গণে মানুষের ঢল। মাকামে ইবরাহিম, হাজরে আসওয়াদ, রহমতের প্রতিটি স্থানে মানুষ দুই হাত তুলে কাতর আর্তনাদরত। কাবার কালো গিলাফ ছুয়ে ভেঙে পড়ছেন বুক ফাটা কান্নায়। রহমতের ছায়াতলে প্রার্থনায় বিলীয়মান হাজার হাজার নর ও নারী।
বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তের মুসলমান পবিত্র কাবা গৃহে ছুটে এসেছেন মনের আকুল আর্তি নিয়ে। ওমরাহে সমবেত হয়েছেন লাখো মুসলিম। আরব দেশে এখন স্কুল-কলেজ ছুটি। স্থানীয় ও বিদেশি মুসলিমদের আগমনে হজের মতো উৎসবমুখর আল্লাহর ঘর বায়তুল্লাহ।
আবহাওয়া এখন খুবই চমকপ্রদ। তীব্র শীত আসার আগে হাল্কা মখমল হাওয়ার আলতো পরশ বইছে ঐতিহাসিক ও পবিত্র মক্কা মহানগরের কোণে কোণে। অনতিদূরের লোহিত সাগরের ভেজা বাতাস উষ্ণ-ঊষর মরুর চরম আবহাওয়াকে বদলে দিয়েছে আরামদায়ক পরিবেশে। পথেঘাটে, হোটেলে, এভিনিউগুলোতে ওমরাহ পালনকারীদের প্রাণময় উপস্থিতির চিহ্ন জ্বলজ্বল করছে।
বায়তুল্লাহর নামাজের জামাত মূল মসজিদ ছাড়িয়ে চলে আসছে আশেপাশের এলাকায়। আজান হলেই বায়তুল্লাহর চারপাশ ছাপিয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে কাতারবদ্ধ সুশৃঙ্খল মুসুল্লির সারি। সারি সারি মানুষের মিছিল সাদা ইহরাম গায়ে চলেছেন কাবা গৃহের সামনের মাতাফ চত্বরে । আল্লাহর একত্ববাদের মহিমায় উচ্চকিত হচ্ছে মানবমণ্ডলীর সমবেত কণ্ঠস্বর।
মানুষ এসেছেন একা ও দলবেঁধে। পরিবার-পরিজন, স্ত্রী, পুত্র, সন্তান নিয়ে। এসেছেন হুইলচেয়ারে বৃদ্ধ পিতা বা মাতাকে নিয়ে। এসেছেন কোলে বা পিঠে অসুস্থ শিশুকে নিয়ে। মানুষ এসেছেন প্রাপ্তির কৃতজ্ঞতা জানাতে। এসেছেন অপ্রাপ্তিকে পূর্ণতায় ভরিয়ে নিতে। বুকচেরা যন্ত্রণার কথা বলতে এসেছেন তাপিত ও পীড়িত মানুষ। বিপন্ন মানুষ এসেছেন অত্যাচার ও নির্যাতনের ফরিয়াদ জানাতে।
পৃথিবীর ভৌগোলিক দূরত্ব ও বিঘ্ন পেরিয়ে মানুষ এসেছেন পবিত্র অঙ্গনে, শান্তি যেখানে শাশ্বত সত্য। হযরত ইবরাহিম আলাইহি ওয়াস সালাম যেখানে শান্তির কথা ঘোষণা করেছিলেন। হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সালাম যেখান থেকে বিশ্বশান্তির ডাক দিয়েছিলেন। সেই শান্তির ডাকে মানুষ এসেছেন এই শান্তির গৃহে, যেখানে ঐতিহাসিক মক্কা বিজয়ের সময়েও মানুষ আশ্রয় ও নিরাপত্তা পেয়েছিলেন। যারা সেদিন আল্লাহ আনুগত্য স্বীকার করে কাবা গৃহে আশ্রয় নিয়েছিল, তারা পেয়েছিল ক্ষমা ও নিরাপত্তা। রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বিশ্বশান্তির মহান ধর্মে।
বিশ্বশান্তির ধর্ম ইসলাম এখন ভেতর ও বাইরে থেকে প্রজ্বলিত সংঘাতের আগুনে চরম অশান্তি ও রক্তপাতের সম্মুখীন। মৃত্যু ও আঘাত যেন ঘিরে ফেলেছে মুসলিম বিশ্বকে। মুসলিম নর-নারী উদ্বাস্তু জীবন কাটাচ্ছেন বিশ্বের পথে-প্রান্তরে। তবু এক মুহূর্তের জন্য ইসলামের অন্তর্নিহিত শান্তির চেতনা থেমে থাকে নি। শান্তির বৈশ্বিক কেন্দ্র বায়তুল্লাহ থেকে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে শান্তির চিরায়ত আহ্বান।
রহমতের ছায়াতলে প্রার্থনার অশ্রুধারা ঝরিয়ে মানুষ ফরিয়াদ জানাচ্ছেন শান্তির জন্য। জুলুম ও নির্যাতনের অবসানে প্রত্যাশা করছেন শান্তির আলোকিত ভোর, সুবহে সাদেক।