মদিনা (সৌদি আরব): বড় শহরগুলোর অনেক সুবিধার মধ্যে অসুবিধা হলো হাতের কাছে সব কিছু পাওয়া যায় না। সুপরিকল্পিত নগর বিন্যাসের আওতায় একেক এলাকা ও জোনে একেক রকম জিনিসের দোকান রয়েছে। বাংলাদেশের শহরগুলোর মতো হাতের কাছে সব কিছু জগাখিঁচুড়ি অবস্থায় পাওয়ার উপায় নেই আন্তর্জাতিক মানের শহরে।
মদিনায় নাগরিক সুযোগ-সুবিধার বিষয়গুলো আরো পরিচ্ছন্ন ও সুবিন্যস্ত। এক সহযাত্রীর চশমা ভেঙে যাওয়ায় ঘুরে ঘুরে যেতে হলো হাসপাতাল পাড়া নামে পরিচিত দাউদিয়া সুলাতানা এলাকায়। আশ শেফা হাসপাতাল কমপ্লেক্সে বেশ কিছু ফার্মেসি ও চশমার দোকান পাওয়া গেলো।
কিন্তু সমস্যা হলো সেখানকার সব কিছুই আন্তর্জাতিক মানের ব্রান্ডের মালামাল। সুপরিচিত কোম্পানির পণ্যের সমাবেশে কম দামের 'মেড ইন জিঞ্জিরা' মার্কা চাইনিজ, জাপানিজ জিনিসের পাত্তা নেই। মানুষের বায়িং ক্যাপাসিটি ভালো বলে চেইন শপের ছড়াছড়ি।
বাজারে সাধারণত মানের কম দামি ও হালকা কিছুই নেই। তাছাড়া ছোটখাট সারাই বা মেরামত করে কোন কিছু ঠিক করার ব্যবস্থাও নেই। সৌখিন ও বিত্তশালী সৌদিরা কোন কিছু নষ্ট বা অপছন্দ হলে ফেলে দিয়ে নতুন আরেকটি কিনে নেন।
নবীর ঠিকানা মদিনায় ইবাদত-আমলের পাশাপাশি ব্যবসারও রমরমা অবস্থা। সৌদিরা এসে কড়কড়ে রিয়েল ফেলে পছন্দের মালামাল কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। দরদাম করছেন না। মূলত সবই ফিক্সড প্রাইসের দোকান।
চাশমার ব্যবসা করেন সৌদি নাগরিক আবদুর রহিম মোহাম্মদ ইয়ামিন। তার দোকানের নাম 'ইয়ামিন অপটিক্যালস'। এমন দোকানের শাখা দেশের বিভিন্ন স্থানে আছে। তিনি প্রতিষ্ঠানের এমডি। আমাদেরকে বললেন, 'আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন। ফলে কোনো হালাল কাজ করতে গিয়ে মানুষকে কষ্ট দেওয়া যাবে না।'
লক্ষ্য করে দেখি, তার দোকানে পণ্যের দাম অপেক্ষাকৃত সস্তা। দোকানে পবিত্র কোরআনের আদেশমূলক আয়াতগুলো ডিসপ্লে করা। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, আরবের অধিকাংশ মানুষই কোরআনের আদেশমূলক বা হুকুমের আয়াতগুলো মুখস্ত করে রেখেছেন। বাসচালক, টেক্সিচালক দিব্যি নিজের কাজ করতে করতে কোরআনের আয়াতগুলো সুরেলা কণ্ঠে, দরদের সঙ্গে তেলাওয়াত করছেন।
আবদুর রহিম মোহাম্মদ ইয়ামিন ফিজিক্সের গ্র্যাজুয়েট। শিক্ষকতা করেছেন কিছুদিন। বাপ-দাদা ব্যবসা করতেন বলে এ পেশার হাল ধরেছেন। বললেন, 'সব কাজ ও পেশাই ইবাদত, যদি তাতে মানুষের সেবার মনোভাব ও কল্যাণ চিন্তা থাকে। আর মানুষকে কষ্ট দিলে ইবাদতেরও ফল পাওয়া যাবে না।'
সৌদিতে মানুষকে সাহায্য করার একটা প্রবণতা সবার মধ্যেই আছে। মক্কা ও মদিনায় জীবন-যাপন ও ব্যবসা-বাণিজ্যকে ছাপিয়ে আধ্যাত্মিকতা অবস্থান করছে সর্বাগ্রে। নামাজের আহ্বান জানিয়ে আজান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাই কাজ বন্ধ করে নামাজে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন। দোকানপাট বন্ধ করে, গাড়ি থামিয়ে আগে নামাজ পড়ে নিচ্ছেন। ফরজ বা আল্লাহ হুকুম মানার ক্ষেত্রে কালবিলম্ব এখানে অকল্পনীয়।
ফরজকে মজবুত করে আকড়ে ধরার পর অতিরিক্ত আমল করা হয় একাকী। সেগুলো লোক দেখানোর বদলে গোপনে করতেই পছন্দ করেন মানুষ। তবুও একটি আমল আরব ভূমিতে খুবই দৃশ্যমান, তা হলো সপ্তাহে বৃহস্পতিবার ও সোমবার রোজা পালন। সেদিনগুলো মক্কা ও মদিনার মসজিদে ইফতারে বসেন হাজার হাজার মানুষ।
আরেকটি লক্ষণীয় আমল হলো শেষ রাতে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায়। মধ্য রাত থেকে ফজরের পূর্ব পর্যন্ত মসজিদ সরগরম থাকে নারী-পুরুষে। 'দারুল ঈমান', 'দারুল ইসলাম' ও 'দারুল আমান'-এর খোশবু ছড়িয়ে পড়ে চতুর্দিকে। শান্তি ও নিরাপত্তার সুবাতাসে আমোদিত মানুষ উদ্ভাসিত হয় তাসবিহ, তাহলিল, হামদ ও সানায়।