আল্লাহতায়ালা মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন একমাত্র তারই ইবাদতের জন্য। এ মর্মে আল্লাহ বলেছেন, ‘আমি জিন ও মানব জাতিকে আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি।’ -সুরা যারিয়াত : ৫৬
ইবাদতের মাধ্যমে বান্দা মহান আল্লাহর একান্ত সান্নিধ্য লাভে ধন্য হতে পারে। প্রতিটি নেক কাজেই রয়েছে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিদানপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা। সুরা আনআমের ১৬০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘কেউ কোনো সৎকাজ করলে সে তার ১০ গুণ সওয়াব পাবে।’ নেক ইবাদতের প্রতিদান প্রসঙ্গে মহানবী (সা.) বলেন, মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা যেকোনো নেক আমলই করবে, আমার কাছে তার ১০ গুণ সওয়াব প্রস্তুত আছে।’ -হাদিসে কুদসি
১০ গুণ সওয়াব দেওয়ার এই ওয়াদা দুনিয়ার কোনো মানুষের নয়, বরং মহান আল্লাহর পক্ষ থেকেই করা হয়েছে। আর এটিকে কোনো বিশেষ নেকির সঙ্গেও সীমাবদ্ধ করা হয়নি; বরং বলা হয়েছে যেকোনো ধরনের নেকি, হোক তা ফরজ কিংবা নফল। হোক একবার সুবহানাল্লাহ বলা কিংবা আলহামদুলিল্লাহ বলা। তার সওয়াব ১০ গুণ বৃদ্ধি পাবে।
মহান আল্লাহর একান্ত ইচ্ছা তার প্রত্যেক বান্দা তারই ইবাদত সম্পন্ন করার মাধ্যমে ইহ ও পরকালীন জীবনকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলবে। ইবাদত মূলত দুই প্রকার। ফরজ ইবাদত, যেমন- নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ইত্যাদি। নফল ইবাদত, যেমন- নফল নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত, দান-খয়রাত, নফল রোজা রাখা ইত্যাদি।
মানব জাতি মূলত তখনই মহান আল্লাহর কাছে প্রকৃত সম্মানিত ও প্রিয় হবে, যখন তার প্রতিটি কাজ হবে একমাত্র তার উদ্দেশ্যে। সুখে-দুঃখে একমাত্র তার ইবাদত করবে, তাকেই ভালোবাসবে। তারই নৈকট্য লাভের চেষ্টায় সর্বদা ব্যস্ত থাকবে। ফরজ ইবাদত সম্পন্ন করার সঙ্গে সঙ্গে নফল ইবাদতে অধিক মনযোগী হবে। নফল ইবাদতগুলোর মধ্যে নফল রোজা বান্দাকে অতি সহজেই মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছে দেয়। কারণ রোজা এমন একটি ইবাদত যা জাহান্নাম থেকে রক্ষার জন্য ঢালস্বরূপ এবং এর প্রতিদান স্বয়ং আল্লাহ দিয়ে থাকেন।
নবী কারিম (সা.)-এর বাণী: কল্যাণকামী মুসলমানরা যেন শুধু রমজানের রোজা রেখেই থেমে না যায়, বরং অল্প কিছু রোজা রেখে পুরো বছরের রোজা রাখার মর্যাদা লাভ করতে পারে তার এক মহাসুযোগ করে দিয়ে নবী কারিম (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজান মাসে ফরজ রোজা পালন করল, অতঃপর শাওয়াল মাসে আরও ছয়দিন রোজা পালন করল, সে যেন সারা বছর রোজা রাখল।’ -সহিহ মুসলিম
অর্থাৎ একজন ব্যক্তি যখন রমজান মাসের রোজা রেখে তার সঙ্গে সঙ্গে শাওয়াল মাসের ছয়টি রোজা রাখল, সে এই রোজার কারণে মহান আল্লাহর দরবারে পূর্ণ একটি বছর রোজা রাখার সওয়াব পেয়ে গেল। অপর এক হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি রমজানের রোজা শেষ করে শাওয়াল মাসে ছয়দিন রোজা রাখবে, সেটা তার জন্য পুরো বছর রোজা রাখার সমতুল্য।’ -মুসনাদে আহমদ
বিশ্লেষণ: যদি কোনো ব্যক্তি রমজান মাসের ৩০টি রোজা রাখে, তাহলে তার ১০ গুণ ৩০০ রাত হবে। আর শাওয়ালের ছয় রোজার ১০ গুণ ৬০ হবে। এমনিভাবে সব রোজার সওয়াব মিলে ৩৬০ দিন হয়ে গেল। আর আরবি দিনপঞ্জির হিসাবে ৩৬০ দিনেই তো বছর পূর্ণ হয়।
শিক্ষা: হাদিসদ্বয় থেকে আমরা যে শিক্ষা পেয়ে থাকি তা হলো- শাওয়ালের ছয়টি রোজার গুরুত্ব ও ফজিলত অবগত হওয়া গেল। ক্ষুদ্র আমল কিন্তু অর্জন বিশাল। বান্দার প্রতি মহান আল্লাহর সীমাহীন দয়ার বহিঃপ্রকাশ। অল্প আমলেই অধিক প্রতিদান প্রাপ্তির নিশ্চয়তা। কল্যাণকর কাজে প্রতিযোগিতাস্বরূপ এই ছয় রোজার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা মোস্তাহাব, যাতে রোজাগুলো ছুটে না যায়। কোনো ব্যস্ততাই যেন পুণ্য আহরণের এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত করতে না পারে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। নফলসমূহ ফরজের ত্রুটিগুলোর ক্ষতিপূরণ করে। অর্থাৎ জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতসারে রোজাদার কর্র্তৃক যে ভুলত্রুটি হয়, নফল রোজা তা দূর করতে সহায়তা করে।
ছয় রোজার উপকারিতা: এ রোজা ফরজ নামাজের পর সুন্নতে মোয়াক্কাদার মতো। যা ফরজ নামাজের অসম্পূর্ণতাকে পূর্ণ করে। অনুরূপভাবে শাওয়ালের ছয় রোজা রমজানের ফরজ রোজার অসম্পূর্ণতাকে সম্পূর্ণ করে এবং তাতে কোনো ত্রুটি থাকলে তা দূর করে।
কখন এবং কীভাবে: শাওয়ালের ছয়টি রোজা রাখা যাবে মাসের শুরু-শেষ-মাঝামাঝি সব সময়। ধারাবাহিকভাবে কিংবা বিরতি দিয়ে যেভাবেই করা হোক, রোজাদার অবশ্যই এর সওয়াবের অধিকারী হবেন। এ কথা স্মরণ রাখতে হবে, শাওয়ালের ছয় রোজার সঙ্গে রমজানের কাজা রোজা আদায় হবে না। উভয় রোজাই আলাদা আলাদা রাখতে হবে। প্রথমে রমজানের কাজা রোজা রাখতে হবে, তারপর ছয় রোজা রাখবে। যদি পুরো মাসই কাজা রোজায় শেষ হয়ে যায় এবং নফল রোজা রাখার সুযোগ না পাওয়া যায়, তবুও মহান আল্লাহ বান্দার মনের আকাক্সক্ষার কারণে তাকে ওই ছয় রোজার সওয়াব দেবেন বলে আমরা আশা করি। মা-বোনদের এ দিকটি খেয়াল রাখা উচিত যে, প্রাকৃতিক কারণে প্রতি রমজানে তাদের যে রোজাগুলো কাজা হয়ে যায়, উচিত হবে প্রথমে সেই কাজা রোজাগুলো আদায় করা। এরপর শরীর সুস্থ ও সুযোগ থাকলে পূর্ববর্তী বছরের কাজা রোজা আদায় করা। যদি কোনো কাজা রোজা না থাকে, তাহলে শাওয়ালের ছয় রোজা রাখাই হবে উত্তম। কারণ নবী কারিম (সা.) বলেছেন, ‘যে রমজানের রোজা রাখবে সে যেন পুরোপুরি রাখে। যার ওপর কাজা রয়ে গেছে, তার রোজাগুলো পূর্ণ হয়েছে বলে গণ্য করা হবে না, কেননা সে তার কাজা আদায় করেনি।’ -মুগনি
উল্লেখ্য, শাওয়ালের রোজা হচ্ছে নফল আর রমজানের রোজা হচ্ছে ফরজ। আর রমজানের কাজা রোজা আদায় করাও ফরজ।
শেষ কথা: প্রত্যেক সুস্থ-সবল ব্যক্তির উচিত শাওয়াল মাসের ফজিলতপূর্ণ ছয়টি রোজা রেখে পূর্ণ এক বছর রোজা রাখার সমান সওয়াব হাসিল করে মহান আল্লাহর একান্ত সান্নিধ্য লাভে ধন্য হওয়া। কোনো মুমিন নারী-পুরুষ যদি তার অপর কোনো ভাই-বোনকে এই রোজা রাখতে উদ্বুদ্ধ করেন এবং সে যদি তার পরামর্শে রোজা রাখেন, তবে উদ্বুদ্ধকারীও সওয়াব পাবেন। উল্লেখ্য, কেউ নফল রোজা রেখে ভেঙে ফেললে তার কাজা আদায় করা ওয়াজিব।