আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনকে একটি রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে বার্বাডোস। ক্যারিবীয় অঞ্চলের ১১তম দেশ হিসেবে তারা এ স্বীকৃতি দিয়েছে। এ নিয়ে জাতিসঙ্ঘের ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে ১৪০টি এখন ফিলিস্তিনকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করে।
বার্বাডোসের পররাষ্ট্র ও বৈদেশিক বাণিজ্যমন্ত্রী কেরি সিমন্ডস জানান, দেশটির মন্ত্রিসভা মনে করে যে, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেওয়ার সময় এসেছে। বার্বাডোস সর্বদা জাতিসঙ্ঘের নীতি মেনে চলে।
তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি, চলমান সংঘাত নিরসনে একটি দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধান হওয়া উচিত। আমরা মুখে একটি দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান দেখতে চাওয়ার কথা বললেও হাস্যকরভাবে বার্বাডোস নিজেই ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়নি। আমরা যদি ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি না দেই তবে আমরা কিভাবে বলতে পারি যে, আমরা দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান চাই?’
বার্বাডোসের নীতির আলোকেই ফিলিস্তিনকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে বলে জানান কেরি সিমন্ডস। তবে সিদ্ধান্তটি দখলদার ইসরায়েলের সঙ্গে বার্বাডোসের সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র বার্বাডোস। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য একে ওয়েস্ট ইন্ডিজের রত্ন বলা হয়। দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত ব্রিজটাউন দেশটির বৃহত্তম শহর, প্রধান বন্দর ও রাজধানী।
বার্বাডোসের মোট আয়তন ৪৩৯ বর্গকিলোমিটার। ২০২২ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে মোট জনসংখ্যা দুই লাখ ৬৭ হাজার ৮০০। বার্বাডোসের বেশির মানুষ খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসী। দেশটিতে চার হাজার মুসলমান রয়েছে, যা মোট জনসংখ্যার মাত্র ১.৫ শতাংশ। তবে দেশটিতে মুসলমানের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে।
বার্বাডোস প্রায় তিন শতাব্দী ধরে ব্রিটিশ ঔপনিবেশ ছিল। ১৯৬৬ সালে দেশটি যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
ক্যারিবীয় অঞ্চলের অন্য দ্বীপগুলোর মতো বার্বাডোসেও ইসলামের যাত্রা শুরু হয়েছিল আফ্রিকান দাসদের মাধ্যমে। ঔপনিবেশিক শাসকরা ক্যারিবীয় অঞ্চলের কৃষি খামার ও খনিতে কাজ করতে বিপুল পরিমাণ দাস আফ্রিকা মহাদেশ থেকে বন্দি করে নিয়ে এসেছিল। ধারণা করা হয়, তাদের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ মুসলিম ছিল।
কিন্তু ইসলামচর্চায় কঠোর বিধি-নিষেধ এবং ধর্মান্তরে বাধ্য করায় তারা মুসলিম পরিচয় রক্ষা করতে পারেনি। তবে বার্বাডোসে খ্রিস্টীয় ১৭ শতক পর্যন্ত মুসলমানদের অস্তিত্ব ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।
বার্বাডোসে ইসলামের নবযাত্রা শুরু হয় একজন মুসলিম বাঙালি মুসলমানের মাধ্যমে। তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে এসেছিলেন। ব্যবসায়ী বিশারত আলী দেওয়ান ১৯১০ সালে বার্বাডোসে যান এবং পরিবার নিয়ে সেখানেই স্থায়ী হন। বিশারত আলীর পথ অনুসরণ করে বার্বাডোসে আসেন রুহুল আমিন, আবদুল গফুর ও নাসরুল হক। তারা সবাই বাঙালি ছিলেন। পরবর্তী সময়ে কিছু গুজরাটি মুসলিম ব্যবসায়ীও বার্বাডোসে যান। বাঙালি ও গুজরাটি এসব মুসলমানদের বংশধররা এখনো বার্বাডোসে বসবাস করেন।
বাঙালি মুসলিম বিশারত আলী ও তার পরিবার বার্বাডোসে ইসলাম প্রচার, মাদরাসা ও মসজিদ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। তাদের অর্থায়ন ও সহযোগিতায় দেশটির প্রথম মসজিদ ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়।
গত শতাব্দীর ৫০-এর দশকে যখন বার্বাডোসে ‘জামে মসজিদ’ নামে প্রথম মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন প্রথম আজান দিয়েছিলেন বিশারত আলীর নাতি আকরাম আলী।
১৯১০ সালে বাঙালি মুসলমানদের মাধ্যমে বার্বাডোসে ইসলামের নতুন যাত্রা শুরু হয়। মূলত বার্বাডোসে ইসলামি শিক্ষার বিস্তার ঘটে গত শতাব্দীর ৬০-এর দশকে। ১৯৪৭ সালে হাফেজ মাওলানা আহমদ দাউদ পাণ্ডুর (রহ.) বার্বাডোসে গমন করেন। তিনি ছিলেন গুজরাটের ডাভেল মাদরাসার শিক্ষার্থী এবং উপমহাদেশের বিখ্যাত তাফসিরবিদ মাওলানা আহমদ আলী লাহোরি (রহ.)-এর শিষ্য। তিনিই বার্বাডোসে প্রথম স্থায়ী মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নেন। তার এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে সহযোগিতা করেন বাঙালি ও গুজরাটি মুসলিম ব্যবসায়ীরা। ১৯৫২ সালে মাওলানা দাউদ পাণ্ডুর (রহ.)-এর উদ্যোগেই বার্বাডোসের প্রথম মাদরাসা ‘কুওয়াতুল ইসলাম’ প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৭১ সালে ব্রাদার দাউদুল হক আধুনিক ইসলামি শিক্ষা কেন্দ্র ‘দি ইসলামিক টিচিং সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬৬ সালে মাওলানা ইউসুফ পাপরিওয়ালা জামে মসজিদের ইমাম ও কুওয়াতুল ইসলাম মাদরাসার শিক্ষক হিসেবে বার্বাডোসে আসেন। বয়সে তরুণ এই আলেম বার্বাডোসে দাওয়াত ও তাবলিগের প্রসার, দ্বিনি শিক্ষার বিস্তার ও আধুনিকায়ন এবং মুসলমানদের সংঘবদ্ধ করতে অনবদ্য অবদান রাখেন।
বার্বাডোসে মুসলমানরা স্বাধীনভাবে ধর্ম পালনের সুযোগ পায়। বর্তমানে দেশটিতে পাঁচটি মসজিদ, একাধিক মুসল্লা (নাজামের স্থান), ইসলামি শিক্ষা কেন্দ্র ও সংগঠন রয়েছে।