অঙ্গ-ভঙ্গি, আকার-আকৃতি ও ইশারা-ইঙ্গিতে চোখ ধাঁধানো শপিং মল, স্বর্ণের দোকান, খাবারের হোটেল থেকে শুরু করে ফুটপাতের দোকানে চলে দরদাম এবং বেচাকেনা। গাড়ি ভাড়া করা কিংবা ঠিকানা জানার ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি। এভাবে মক্কার বাসিন্দারা ভিনদেশি হজযাত্রীদের সঙ্গে বছরের পর বছর ভাষার দূরত্ব কাটিয়ে যোগাযোগ করছেন। অনেকে আবার নিজ আগ্রহে একটু একটু করে শিখে নিচ্ছে ভিনদেশি কোনো ভাষা।
ফলে হজের সফরে এক মাসের বেশি ও উমরায় প্রায় ১৫ দিন মক্কা-মদিনায় থাকলেও একেবারে অশিক্ষিতরাও সেখানে উল্লেখযোগ্যভাবে কোনো সমস্যার মুখোমুখি হন না। সারা বছর মক্কা-মদিনায় বিভিন্ন দেশের মানুষজনের আনাগোনা লেগে থাকে। তবে হজের সময় প্রায় দুই মাস থাকে বেশি জনসমাগম।
মক্কার স্থানীয়রা বিভিন্ন ভাষাভাষী লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ ও কথাবার্তার সাবলীলতার জন্য দারুণভাবে প্রশংসিত। ভিনদেশিদের সঙ্গে আচার-আচরণ দ্বারা সম্পর্ক স্থাপন এ অঞ্চলের লোকদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। মক্কা-মদিনার বিভিন্ন সেক্টরে কর্মরতদের জন্য এমন যোগ্যতা তাদেরকে মৌসুমি চাকরি নিশ্চিত এবং হজ সম্পর্কিত বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে নিয়োগ পেতে সহায়তা করে। এটা হজযাত্রীদের সেবা, তাদের চাহিদা মেটানো এবং তাদের বিশ্বাস অটুট রাখার নিশ্চয়তা দেয়।
মক্কার বাসিন্দা আনাস আল-হারিথি। প্রতি বছর হজের সময় অস্থায়ীভাবে শপিংমলে কাজ করেন।
তিনি এটাকে একটি দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। হারিথি নিজ আগ্রহে ইন্দোনেশিয়ান ভাষা কিছুটা রপ্ত করেছেন। প্রতি বছর ইন্দোনেশিয়া থেকে সবচেয়ে বেশি হজযাত্রী হজ পালনে মক্কায় আসেন।
আল-হারিথি বলেন, কীভাবে যেন ভাষাগত বাধা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে, কারণ মক্কার অনেক লোক দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ভাষায় সাবলীল।
হজের সময় বছরের পর বছর কাজ করার মাধ্যমে, আল হারিথি হজযাত্রা সম্পর্কিত বিস্তৃত জ্ঞান অর্জন করেছেন। এটা তার কর্মক্ষেত্রকে সহজ ও মসৃণ করে তুলেছে।
তিনি বলেন, বেশিরভাগ মক্কার বাসিন্দা আনুষ্ঠানিক কোনো শিক্ষার মাধ্যমে নয় বরং হজযাত্রীদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে বিভিন্ন ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন, যা তাদেরকে কার্যকরভাবে হাজিদের চাহিদা মেটাতে সক্ষম করে।
ভারত থেকে আগত হজযাত্রীদের গাইড রাফি চৌধুরী বলেন, হজ-উমরা মক্কাবাসীদের জন্য কাজ করার, সেবা করার এবং এই মহৎ পেশার সম্মান উপভোগ করার একটি বড় সুযোগ।
হজযাত্রীদের স্বাগত জানানো, তাদের প্রয়োজন মেটানো এবং তাদের যাত্রাপথ যতটা সম্ভব মসৃণ এবং আরামদায়ক করার ক্ষেত্রে মক্কার অনেকেই উর্দুতে যোগাযোগ করা শিখে গেছে।
চৌধুরী বলেন, যেসব দেশে থেকে কম মানুষ আসেন, তাদের জন্য যেমন আকার-ইশারা, ভাঙা ইংরেজি দিয়ে ভাব বিনিময় করা হয়, তেমনি যেসব দেশের মানুষ বেশি আসেন ওই সব দেশের কিছু শব্দ তারা নিজ আগ্রহে শিখে নেন। তাদের এই আগ্রহ হজযাত্রীদের সেবা করার, তাদের আতিথেয়তার, তাদের স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করার এবং হজের সময় তাদের আচার-অনুষ্ঠান পালনে দারুণভাবে সহায়তা করে।
চৌধুরী যোগ করেছেন, স্থানীয় পুলিশ থেকে শুরু করে সরকারি স্বেচ্ছাসেবকরা হজযাত্রীদের মক্কায় পৌঁছানোর সময় থেকে, মসজিদে হারামে নামাজের সময়, হজ-উমরার বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা পালনের সময় ভাষাগত বাধা অতিক্রম করে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়। যা হজযাত্রীদের ইবাদত-বন্দেগি পালনে সহায়ক। এ সম্পর্ক অনেকটা মানবিক ও আধ্যাত্মিক। যা ধর্মীয় সম্পর্ক দ্বারা চালিত।
স্থানীয় চিকিৎসক রায়হান মোশাহিদ বলেন, ‘এটি আল্লাহর সামনে পালন করা একটি বাধ্যবাধকতা ও সৌভাগ্য। যারা আল্লাহর মেহমান হিসেবে মক্কায় এসেছেন, তাদের চাহিদা বোঝা এবং তাদের ভাষায় যোগাযোগ করা জরুরি কিছু নয়। আপনি হৃদয় খুলে তার মুখের দিকে তাকান, আপনি বুঝে যাবেন তার কি দরকার। বলতে পারেন, এটা মক্কার বরকত।’
মদিনা ইসলামিক ইউনিভার্সিটির ভাষাবিজ্ঞানের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আওয়াদ আল-মালিকি বলেন, সারা বিশ্ব থেকে মক্কায় আগত হজযাত্রীদের এই সমাজকে জানার, এর সংস্কৃতি এবং সামাজিক জীবন অনুভব করার, সৌদি ঐতিহ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যতা রক্ষার প্রবল ইচ্ছা রয়েছে। এর সঙ্গে জ্ঞান বিনিময় এবং গঠনমূলক সাংস্কৃতিক অংশীদারিত্বে জড়িত। ফলে চোখের ভাষায় যোগাযোগটা হয়ে যায়।
তিনি বলেন, হজযাত্রীরা সৌদি আরবকে শুধু ইসলামিক বিশ্বের প্রাণকেন্দ্র হিসেবেই দেখেন না বরং একটি স্বতন্ত্র ও উন্মুক্ত সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে দেখেন, যা সমগ্র ইসলামিক বিশ্বকে একত্রিত করে।
সৌদির বাসিন্দারা হজযাত্রীদের অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির জন্য ভাষাগত যোগাযোগের বিষয়ে উত্সাহী। ফলে তারা ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, উর্দু, মালয়, বাংলা এবং হাউসাসহ বিভিন্ন ভাষায় ধীরে ধীরে পারদর্শী হয়ে যায়।
আরব নিউজ অবলম্বনে