মানুষ অভ্যাসের দাস, তবে সেই অভ্যাস যেন অন্যের বিরক্তির কারণ না হয়, সেদিকে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষকে খেয়াল রাখতে হবে। অন্যথায় দৈনন্দিন নানা সমস্যায় পড়তে হয়, অনেক সময় লজ্জা পেতে হয়। তেমনি কিছু অভ্যাস ও সেগুলো থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে আজকের আলোচনা।
হিংসা
হিংসা জীবনকে পিছিয়ে দেয়। অপরের ভালো বা সুখ দেখে হিংসা না করে বরং নিজে সেই গুণগুলো অর্জনের চেষ্টা করুন। নিজের যা কিছু আছে তা নিয়ে সুখী হওয়ার চেষ্টা করা উচিত। বরং হিংসা না করে অন্যের ভালো কিছু অনুসরণ করে সে রকম হওয়ার চেষ্টা করুন। নিজে নিজে অনুধাবন করার চেষ্টা করুন, আপনি হিংসা করছেন, এতে আপনার কোনো লাভ হচ্ছে কি?
হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, নবী কারিম (সা.) বলেন, ‘তোমরা হিংসা থেকে বেঁচে থাকো। কেননা হিংসা নেক আমলকে এমনভাবে ধ্বংস করে দেয়, যেমন আগুন কাঠের টুকরোকে খেয়ে ফেলে (জ্বালিয়ে দেয়)।’ -সুনানে আবু দাউদ
সন্দেহ
সন্দেহ নিঃসন্দেহে খারাপ অভ্যাস। সম্পর্কে ফাটল ধরায়। সন্দেহপ্রবণ মানুষ নিজেকে নিয়ে নিজের অবস্থান নিয়ে শঙ্কিত থাকে। তার এ অভ্যাসে অন্যরাও বিরক্ত হয়।
কোনো বিষয়ে কাউকে সন্দেহ না করে বরং ওই ব্যক্তিকেই সরাসরি জিজ্ঞেস করুন। আসল সত্যটা জানার চেষ্টা করুন। সন্দেহ থেকে দূরে থাকার সবচেয়ে ভালো পন্থা নিজের বিষয়ে সচেতন ও আত্মপ্রত্যয়ী হওয়া। আপনি এমন ঘটনা ঘটাতে পারেন না- এমন আত্মবিশ্বাস ধরে রাখুন। আপনাকে কেউ সন্দেহ করলে চুপ থাকুন। আসল সত্য এমনিতেই বেরিয়ে আসবে। কোরআনে করিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা! তোমরা অধিকাংশ (অহেতুক) অনুমান থেকে দূরে থাক। কারণ (অহেতুক) অনুমান কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাপ।’ -সুরা হুজরাত : ১২
পরনিন্দা
কারণে-অকারণে অপরের দোষ-ত্রুটি সবাইকে বলে বেড়ানো বাজে অভ্যাস। অনেক সময় অপরে যা করেনি তাও বানিয়ে বানিয়ে বলতে দেখা যায় কাউকে। অপরের দোষ-ত্রুটি গোপন রাখুন। প্রচার করবেন না। মনে রাখবেন, আপনারও ভুল হতে পারে। পরনিন্দা ব্যক্তিগত ও সামাজিক সম্পর্কে ফাটল ধরায়। এরকম বাজে অভ্যাস হলে নিজে নিজে সচেতন হয়ে কাটিয়ে উঠুন।
কোরআন মজিদে বলা হয়েছে, ‘হে ইমানদাররা! তোমরা একে অপরের পেছনে নিন্দা করো না। তোমাদের কেউ কী স্বীয় মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করতে পছন্দ করবে? বস্তুত তোমরা তা একেবারেই ঘৃণাই করো।’ -সুরা হুজরাত : ১২
অন্যের দোষ খোঁজা
অযথা কারও দোষ ধরবেন না। কেউ কোনো ভুল করলে অন্যায় করলে নিজেই সংশোধন করে নিন। কারও কথা-বার্তা, চালচলন পছন্দ না হলে চুপ থাকুন, তবে সেটি যদি আপনার জন্য ক্ষতির কারণ হয়।
অন্যের দোষ না খুঁজে, তার ভালো দিক খুঁজে বের করার মধ্যেই আনন্দ। দোষ যদি বলতেই হয় সবার সামনে না বলে আড়ালে শুধরে দিন। দেখুন কোরআন মজিদে কত সুন্দর করে বলা হয়েছে, ‘তোমরা একজন অপরজনের দোষ-ত্রুটি খোঁজা-খুঁজি করো না এবং কারও অগোচরে গিবত করো না।’ -সুরা হুজরাত : ১২
পক্ষপাতিত্ব
আপনার বন্ধু কিংবা আপনজন অন্যায় করলে, খারাপ ব্যবহার করলে তাকে ছেড়ে দেবেন না; নিরপেক্ষ বিচার করুন। অন্যায় করলে ক্ষমা চাইতে বলুন। পক্ষপাতহীন আচরণ ব্যক্তিত্বকে দৃঢ় করে।
পক্ষপাত দুষ্ট মানুষকে কেউ কখনো পছন্দ করে না। পক্ষপাত আচরণে অন্যের ক্ষতি হতে পারে। কোনো কিছু করার আগে অন্তত একবার ভেবে দেখুন, সবার প্রতি আচরণ ঠিক আছে কি না। নিজে বুঝতে না পারলে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আলোচনা করে নিতে পারেন। দেখুন হাদিস কী বলে, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘মানুষ যখন কোনো অত্যাচারীকে দেখেও অন্যায় থেকে তার হাতকে প্রতিরোধ করবে না, শিগগিরই আল্লাহ তাদের সবার ওপর ব্যাপক আজাব নাজিল করবেন।’ - সুনানে তিরমিজি
মোবাইলে কথোপকথন
অনেকেই অহেতুক জোরে জোরে মোবাইল ফোনে কথা বলেন। অন্যরা এতে বিরক্ত হতে পারে। অনেকে আছেন কোনো গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার মধ্যেও কথা বলতে থাকেন। অনেকের মোবাইল ফোনের রিংটোনও অনেক সময় বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
মোবাইল ফোনে কথা বলার সময় খেয়াল রাখুন আপনার কথায় অন্যের অসুবিধা হচ্ছে কি না। জরুরি হলে অন্য জায়গায় গিয়ে কথা বলুন। গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার সময় ফোন সাইলেন্ট রাখুন। কাছের মানুষদের জানিয়ে রাখুন এ সময় আপনি ব্যস্ত থাকেন, জরুরি না হলে ফোন না করতে। ফোনের রিংটোন আপনার রুচির প্রকাশ করে। তাই সচেতন থাকুন।
এ বিষয়ে হাদিসের শিক্ষা আমাদের জন্য পাথেয়। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) তোমাদের মতো দ্রুত কথা বলতেন না। বরং তিনি কথা বলতেন স্পষ্ট ভাষায়, পৃথক পৃথক বাক্যে। ফলে উপস্থিত যে কেউ তার কথা সহজেই মুখস্থ করে নিতে পারত।’ -শামায়েলে তিরমিজি : ১৮
আরও কিছু বাজে অভ্যাস
মানুষের সামনে আঙুল মটকানো, নাক-মুখে রুমাল বা হাত না দিয়ে দাঁত খোঁচানো, হাঁচি-কাশি দেওয়া, যেখানে সেখানে পানের পিক ফেলা, থুথু ফেলা, মেঝেতে পা ঘষে হাঁটা, দাঁত দিয়ে নখ কাটা, উচ্চস্বরে কাশি দিতে থাকা, বেতন ও বয়সের কথা জানতে চাওয়া, সন্তান হচ্ছে না কেন জিজ্ঞেস করা।
আঁতর কিংবা পারফিউমের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার না করা। কারণ আপনার পছন্দের সুগন্ধ অন্যের বিরক্তের কারণ হতে পারে। এ ছাড়া মুখের দুর্গন্ধ, কাপড়ে ও শরীরে ঘামের গন্ধ যে বাইরে না আসে সে বিষয়েও সতর্ক থাকুন। খাবারগ্রহণ এবং চা পানের সময় শব্দ না করা, আপেল-কমলা-কলা দুই এক কামড় খেয়ে রেখে না দেওয়া, পানি পরিবেশনের সময় গ্লাস ধুয়ে গ্লাসের পানি না মুছে পানি দেওয়া ও দুর্গন্ধযুক্ত মোজা ব্যবহার করা।
উল্লিখিত বিষয়গুলো বিরক্তিকর অভ্যাস, এগুলো পরিত্যাগ করা জরুরি।
প্রশ্ন হতে পারে, কীভাবে ত্যাগ করবেন। দেখুন, অভ্যাস তো আপনিই সৃষ্টি করেছেন। আপনার তো ভালো অভ্যাসও আছে। সুতরাং অভ্যাসের পরিবর্তন করার দায়িত্বও একান্তই আপনার। এ জন্য প্রয়োজন শুধু সচেতনতা আর সদিচ্ছা। বাজে অভ্যাস পরিবর্তনের বিষয়ে সচেতন থাকুন। কাছের জনকেও বলুন শুধরে দিতে। আপনার আশপাশে এমন মানুষ আছে, যাদের মধ্যে আপনার বাজে অভ্যাসগুলো নেই। তাদের অনুসরণ করতে পারেন। প্রয়োজনে মনোচিকিৎসকের পরামর্শ নিন।