এক কোটি ৭৮ লাখ জনসংখ্যার দেশ ইকুয়েডর। তাদের মধ্যে বেশির ভাগ খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসী। দেশটিতে সামান্যসংখ্যক মুসলিম বসবাস করেন, আনুমানিক সংখ্যা দুই থেকে চার হাজার।
কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো, গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক থেকে ইকুয়েডরে ইসলাম গ্রহণের হার বাড়ছে। এখন প্রায় প্রতি শুক্রবার দেশটিতে কাউকে না কাউকে ইসলাম গ্রহণ করতে দেখা যায়। এভাবেই দিন দিন বাড়ছে ইকুয়েডরে মুসলমানের সংখ্যা।
জীববৈচিত্র্য, প্রাকৃতিক ও খনিজসম্পদে সমৃদ্ধ ইকুয়েডরের অবস্থান দক্ষিণ আমেরিকায়। দেশটির পূর্বে কলম্বিয়া, উত্তর-পশ্চিমে পেরু এবং দক্ষিণে প্রশান্ত মহাসাগর অবস্থিত। তেল, স্বর্ণসহ খনিজসম্পদ, কৃষি ও মাছ আহরণ দেশটির অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। দেশটির মোট আয়তন দুই লাখ ৮৩ হাজার ৫৬১ বর্গকিলোমিটার।
ধারণা করা হয়, ইকুয়েডরে স্প্যানিশ উপনিবেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর স্পেন থেকে নির্বাসিত মুসলিম ও আফ্রিকান মুসলিম দাসদের মাধ্যমে সেখানে মুসলমানের আগমন ঘটে। তবে এর স্বপক্ষে জোরালো কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায় না।
স্বীকৃত ইতিহাস হলো, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিসর, সিরিয়া, লেবানন ও ফিলিস্তিনের মুসলিমরা ইকুয়েডরে বসতি স্থাপন করে। তাদের মাধ্যমে দেশটিতে ইসলামের যাত্রা শুরু হয়।
স্প্যানিশ উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার আগে ইকুয়েডরের মানুষ সূর্য দেবতার পূজারি ছিল। স্প্যানিশরা সেখানে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করে এবং তাকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করে।
ইকুয়েডরে মিসর, সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও লেবাননের মুসলিমরাই প্রথম স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সময় মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে যেসব মুসলিম ইকুয়েডরসহ লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে পাড়ি জমিয়েছিল, তাদের বড় একটি অংশই ছিল উসমানীয় পাসপোর্টধারী। এ জন্য নৃতাত্ত্বিক আরব হলেও তারা তুর্কি হিসেবেই পরিচিত।
ইকুয়েডরে আশ্রয় নেওয়া মুসলিমদের বেশির ভাগ রাজধানী কিতো ও বন্দরনগরী গুয়াকিলে আবাস গড়ে। এ ছাড়া দেশটির উপকূলীয় অঞ্চল মানাব, লসরিওস, এসমেরালডাজেও মুসলিম উপস্থিতি রয়েছে। মূলত ইকুয়েডরের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ এবং পরিবারভিত্তিক সামাজিক কাঠামো মুসলমানদের আকৃষ্ট করেছিল।
প্রথম ধাপে ইকুয়েডরে আগমনকারী মুসলিমদের বেশির ভাগ ছিল ব্যবসায়ী। দেশটির অর্থনীতিও তখন অনেকটাই পণ্য বিনিময়ের ওপর নির্ভরশীল ছিল। প্রথম দুই-তিন দশক মুসলমানের জন্য অত্যন্ত কঠিন সময় ছিল। মুসলিম ব্যবসায়ীরা হেঁটে অথবা খচ্চরের পিঠে চড়ে প্রত্যন্ত গ্রামে যেতেন এবং পণ্য সংগ্রহ করতেন। মুসলিম অভিবাসীরা বিচিত্র সংস্কৃতি, পোশাক ও খাবারের মুখোমুখি হয়েছিল। স্থানীয়দের সঙ্গে খাদ্য, পোশাক ও আরব সংস্কৃতি বিনিময়ের সুযোগ পেয়েছিল।
প্রথম ধাপে আগমনকারী মুসলিমদের বড় একটি অংশ নিজ দেশের রাজনৈতিক প্রতিকূলতা ও অর্থনৈতিক আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এসেছিল। তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ ও চেতনা ছিল দুর্বল। ফলে তারা স্থানীয় অমুসলিমদের সঙ্গে সহজেই একীভূত হয়ে যায়। ইকুয়েডরে বসতি স্থাপনকারী আরবদের মধ্যে দাসসুম, সুলুহ, শায়িব, আরিজ, বিজদাজ, জিরালা পরিবার অন্যতম। পরবর্তী সময়ে তাদের খুব কমসংখ্যক পরিবারই ঈমান-ইসলামের ওপর টিকে থাকে।
গত শতকের নব্বইয়ের দশকে ভারত, পাকিস্তান ও আফ্রিকার নানা অঞ্চল থেকে একদল মুসলিম ইকুয়েডরে বসতি স্থাপন করে। এ ছাড়া আশির দশকে ইকুয়েডরের কিছু নাগরিক বিদেশের মাটিতে ইসলাম গ্রহণ করে। ইসলামের সাম্য, মৈত্রী ও মানসিক প্রশান্তি তাদের আকৃষ্ট করেছিল। স্থানীয় পর্যায়েও অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করেছে। এই নও-মুসলিমরা ইসলাম প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
গত শতকের আশির দশকে ইকুয়েডরে প্রথম মসজিদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হয়। কিন্তু নানা কারণে প্রচেষ্টাটি ব্যর্থ হয়। অবশেষে দাতব্য প্রতিষ্ঠান ‘দ্য সেন্ট্রো ইসলামিকো ডেল ইকুয়েডর’-এর প্রচেষ্টায় দেশটির প্রথম মসজিদ ‘আস-সালাম’ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠানটি ১৫ অক্টোবর ১৯৯৪ যাত্রা শুরু করে। সংগঠনটি সুন্নি মতাদর্শে বিশ্বাসী।
অবশ্য এর আগে ১৯৯১ সালে কয়েকজন মুসলমানের উদ্যোগে ‘মসজিদে খালিদ বিন ওয়ালিদ’ নামে একটি ‘নামাজ ঘর’ (পূর্ণাঙ্গ মসজিদ নয়, তবে নিয়মিত নামাজ হয়) প্রতিষ্ঠা করা হয়, যা ২০১৩ সালে পূর্ণাঙ্গ মসজিদের অবয়ব লাভ করে।
ইকুয়েডরে ইসলামি পঠনসামগ্রীর অভাব রয়েছে। বর্তমানে দাতব্য সংস্থাগুলো প্রয়োজনীয় বইপত্র স্প্যানিশ ভাষায় অনুবাদ করে তা স্থানীয় মুসলিমদের মধ্যে বিতরণ করে।
ইকুয়েডরে ইসলাম প্রচারে ড. ইয়াহইয়া জুয়ান সুকাইলি ও তার স্ত্রী ড. লায়লা দাসুম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তারা ২০০৯ সালে প্রভাবশালী পাঁচ শ মুসলিমের তালিকাভুক্ত হন। এর কারণ হিসেবে বলা হয়, তারা স্প্যানিশ ভাষায় ইসলামি সাহিত্য প্রকাশ করেন। ড. ইয়াহইয়া স্প্যানিশ ভাষায় নবী কারিম (সা.)-এর জীবনীর ধারাভাষ্য রেডর্ক করেন এবং সিডি আকারে প্রকাশ করেন। এটাই ছিল স্প্যানিশ ভাষায় সিরাতের ওপর প্রথম কোনো কাজ।