আত্মপ্রসিদ্ধি অন্বেষী আলেম, শহীদ ও দানবীরের পরিণতির বিষয়ক হাদিসের কথা সবাই জানি। তাদের প্রত্যেককেই জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হয়। হাদিসটি জামে তিরমিজি ও অন্যান্য কিতাবে যে আঙ্গিকে বর্ণিত হয়েছে সেটি জানলে হৃদয়ে আরও বেশি রেখাপাত করে।
শামের শুফাই ইবনে মাতি একদিন মদিনায় এলেন। মদিনার মসজিদে নববিতে গিয়ে দেখেন, একজনকে ঘিরে অনেক লোক সমবেত। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কে এই লোক?
লোকেরা বলল, তিনি হজরত আবু হুরায়রা (রা.)।
সুফাই বলেন, আমি তার নিকটবর্তী হলাম। এমনকি তার সামনে গিয়ে বসলাম। তিনি লোকদেরকে হাদিস শোনাচ্ছেন। যখন হাদিস শোনানো শেষ হল এবং সবাই চলে গেল, তিনি একাকী হলেন। আমি তখন বললাম, আমি আপনার কাছে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে আবেদন করছি, আপনি আমাকে একটি হাদিস শোনান, যা আপনি ভালোভাবে শিখেছেন এবং বুঝেছেন।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বললেন, হাঁ শোনাবো। আমি তোমাকে একটি হাদিস শোনাবো, যা আমি ভালোভাবে শিখেছি এবং বুঝেছি। এই বলে তিনি বেহুঁশ হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ আমরা এভাবে কাটালাম। এরপর তার হুঁশ ফিরে এল। তখন তিনি বললেন, অবশ্যই আমি তোমাকে এমন একটি হাদীস শোনাব, যা নবীজী এই মসজিদে আমাকে শুনিয়েছেন। তখন তিনি আর আমি ছাড়া আর কেউ ছিল না। এই বলে তিনি আবার বেহুঁশ হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর হুঁশ ফিরে এলে তিনি তার চেহারা মুছে নিলেন এবং বললেন, আমি অবশ্যই তোমাকে এমন হাদিস শোনাব, যা নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে এই মসজিদে শুনিয়েছেন। তখন আমরা দুজন ছাড়া মসজিদে আর কেউ ছিল না। এই বলে তিনি আবার বেহুঁশ হয়ে যান এবং উপুড় হয়ে পড়ে যান।
আমি তাকে দীর্ঘ সময় হেলান দিয়ে বসিয়ে রাখি। এরপর তার হুঁশ ফেরে। এরপর তিনি বলেন, নবীজী (সা.) আমাকে বলেছেন- যেদিন কেয়ামত হবে এবং আল্লাহতায়ালা বান্দাদের মাঝে ফয়সালার জন্য অবতরণ করবেন তখন প্রত্যেক উম্মত হাঁটু গেড়ে অবনত হয়ে থাকবে। এ সময় সর্বপ্রথম আল্লাহতায়ালা যাদেরকে ডাকবেন, তারা হলো একজন আলেম, একজন শহীদ ও একজন ধনী। তখন আল্লাহতায়ালা কোরআনের আলেমকে বলবেন, আমি কি তোমাকে আমার রাসুলের ওপর যা নাজিল করেছি তা শেখাইনি?
আলেম বলবে- অবশ্যই, হে আমার রব।
আল্লাহতায়ালা বলবেন, তাহলে তুমি কী আমল করেছ?
সে বলবে, আমি দিন-রাত সবসময় কোরআনে কারিম পড়তাম, তা দিয়ে নামাজ পড়তাম, তার ওপর আমল করতাম।
তখন আল্লাহতায়ালা বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। আর ফেরেশতারাও বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। আল্লাহতায়ালা বলবেন, তুমি চেয়েছো- যেন তোমাকে বিরাট আলেম বলা হয়; আর তা বলাও হয়েছে।
এরপর ধনীকে আনা হবে। তাকে আল্লাহতায়ালা বলবেন, আমি কি তোমার ওপর দুনিয়া এত প্রশস্ত করে দেইনি যে, তোমাকে কারও মুখাপেক্ষী হতে হয়নি?
সে বলবে- হাঁ, অবশ্যই, হে আমার রব!
আল্লাহতায়ালা বলবেন, আমি যা দান করেছি তাতে তুমি কী আমল করেছ? সে বলবে, আমি আত্মীয়তার হক আদায় করতাম এবং দান-সদাকা করতাম। আল্লাহতায়ালা বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। ফেরেশতারাও বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। আল্লাহতায়ালা বলবেন, তুমি চেয়েছ- তোমাকে যেন ‘দানবীর’ বলা হয়; আর তা বলা হয়েছেও।
এরপর আল্লাহর রাস্তার শহীদকে আনা হবে। আল্লাহতায়ালা তাকে বলবেন, তুমি কী উদ্দেশ্যে শহীদ হয়েছ?
সে বলবে, আপনি আপনার রাস্তায় জিহাদ করতে বলেছেন। তাই আমি লড়াই করেছি এবং শহীদ হয়েছি।
আল্লাহতায়ালা বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছ। ফেরেশতারাও বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছ। আল্লাহতায়ালা বলবেন, তুমি চেয়েছ- যেন তোমাকে বীর ও সাহসী বলা হয়; আর তা বলা হয়েছেও।
তারপর নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার হাঁটুতে চাপ দিয়ে বলেন, হে আবু হুরায়রা! এই তিনজনই আল্লাহতায়ালার প্রথম মাখলুক, যাদের দিয়ে কেয়ামতের দিন জাহান্নামের আগুন প্রজ্বলিত করা হবে। -জামে তিরমিজি : ২৩৮১
এরপর ‘সুফাই’ শামে ফিরে আসেন এবং হজরত মুয়াবিয়া (রা.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে হাদিসটি শোনান। তখন হজরত মুয়াবিয়া (রা.) বলেন, যদি তাদের সঙ্গে এমন করা হয়, তাহলে অন্য মানুষদের অবস্থা কী হবে! এরপর তিনি এমনভাবে কাঁদেন যে, বর্ণনাকারী বলেন, আমরা ভেবেছি তিনি মারা যাবেন। আমরা বলতে লাগলাম, এই লোক (সুফাই) খারাপ কিছু নিয়ে এসেছে। এরপর হজরত মুয়াবিয়া (রা.)-এর হুঁশ ফিরে আসে। তিনি তার চেহারা মুছে নেন। এরপর বলেন, আল্লাহতায়ালা এবং তার রাসুল সত্যই বলেছেন, অর্থাৎ যে ব্যক্তি দুনিয়ার ভোগ-সামগ্রী ও চাকচিক্য চায়, তার জন্য আখেরাতে আগুন ছাড়া আর কিছুই নেই। আর তাদের কৃত আমল সব বাতিল হয়ে যাবে। -সূরা হুদ : ১৫
এরপর হজরত মুয়াবিয়া (রা.) জাহান্নাম থেকে পানাহ চেয়ে এই আয়াত তেলাওয়াত করেন, ‘নিশ্চয় তোমাদের ইলাহ এক ইলাহ। সুতরাং যে তার রবের সাক্ষাতের আশা করে, সে যেন নেক আমল করে এবং তার রবের ইবাদতে কাউকে শরিক না করে’ -সূরা কাহাফ : : ১১০। -জামে তিরমিজি : ২৩৮২
অর্থাৎ ইলাহ যেহেতু একজনই, তাই আমল দ্বারা তিনিই উদ্দেশ্য হতে হবে। তার সঙ্গে কাউকে শরিক করা যাবে না। শরিক করা মানে হল, তাকেও ইলাহ বানানো। রিয়া বা আত্মপ্রসিদ্ধির উদ্দেশ্যে দ্বীনের কাজ করা মানে আল্লাহর সঙ্গে শরিক করা। তাই সাহাবি হজরত মুয়াবিয়া (রা.) এ আয়াতটি পড়েন। এ আয়াতকে তো আমরা সাধারণত মুশরিকদের ক্ষেত্রে বলে থাকি। কিন্তু হজরত মুয়াবিয়া (রা.) এ আয়াতকে আত্মপ্রচারকারীদের ক্ষেত্রে হুবহু প্রয়োগ করেন। এ থেকে তো বোঝা যায়, আত্মপ্রচার গুপ্ত শিরক হওয়া সাহাবিদের নিকট কত পরিষ্কার ছিল।
আফসোসের কথা হলো, আজ আমরা একে (আত্মপ্রচারকে) শিরক তো মনেই করি না, এমনকি ন্যূনতম গুনাহও মনে করি কিনা সন্দেহ! তাই আজ আমরা সবাই এ ধরনের আত্মপ্রচারের যা-ই পাই, তা দিয়ে আত্মপ্রচারে ভেসে যাচ্ছি এবং কে কার চেয়ে বেশি প্রসিদ্ধ ও ভাইরাল হতে পারি- এ নিয়ে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকি।
বর্ণিত হাদিস থেকে আরও একটি বিষয় বোঝা যায়। কেউ যদি প্রসিদ্ধ হওয়ার উদ্দেশ্যে কোনো দ্বীনী কাজ করে, তাহলে সে প্রসিদ্ধ ও ভাইরাল হয়েও যেতে পারে। কেননা, হাদিসে তিনজন ব্যক্তির ক্ষেত্রেই বলা হয়েছে, ‘তুমি যে প্রচার-প্রসিদ্ধি চেয়েছ, তা হয়েছে।’
এক্ষেত্রে আরও বোঝা দরকার, এ ধরনের প্রসিদ্ধ হওয়ার অর্থ আল্লাহর কাছে কবুল হওয়া নয়। এমন মনে করা চরম ভুল।
এক হাদিসে এসেছে, নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, সম্পদের লোভ ও মর্যাদার লোভ, একজন মুমিনের দ্বীনকে যেভাবে ধ্বংস করে, দুইটি ক্ষুধার্ত নেকড়েও একটি বকরির পালকে তত ধ্বংস করতে পারে না। -মুসনাদে আহমাদ : ৩/৪৫৬
দুইটি ক্ষুধার্ত নেকড়েকে যদি একটি বকরির পালে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে পুরো পালকে যে শেষ করে দেবে- জানা কথা। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, সম্পদের লোভ ও মর্যাদার লোভ মানুষের দ্বীনকে এর চেয়েও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ও ধ্বংস করে।