মাইকাও শহরের মুসলমানদের খোঁজখবর

দেশে দেশে ইসলাম, ইসলাম

ইসলাম ডেস্ক, বার্তা২৪.কম | 2024-09-12 20:27:28

দক্ষিণ আমেরিকান দেশ কলম্বিয়া। দেশটির সীমান্তবর্তী মাইকাও হলো কলম্বিয়া-ভেনেজুয়েলা সীমান্তের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের একটি ছোট শহর। ধুলোবালিতে ভরপুর শহরটির বিভিন্ন প্রান্ত কলম্বিয়ার লা গুয়াজিয়া প্রদেশ সংলগ্ন। যা একসময় ছিলো কলম্বিয়ার আরব ও মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রাণকেন্দ্র।

এখন মাইকাও ঠিক তা নয়, যা হওয়ার কথা ছিল। যদিও এখানে আরব সম্প্রদায়ের প্রভাব অনেকদিন ধরেই। শহরটিতে আছে মসজিদ, আরব স্কুল এবং রাস্তার ওপর একটি ছোটখাটো আরব-পরিচালিত ব্যবসায়িক সাজসজ্জা। এ কথা উল্লেখ না করলেও চলে, শহরটির শাসনভার পরিচালনার দায়িত্বে আছেন লেবানিজ-কলম্বিয়ান মোহাম্মদ জাফর দাসুকি হাজি। কলম্বিয়ার ইতিহাসে প্রথম মুসলিম মেয়র তিনিই।

মোহাম্মদ জাফর দাসুকি, কলম্বিয়ার প্রথম মুসলিম মেয়র, ছবি: সংগৃহীত

শহরটির আকাশে ‘দ্য ওমর ইবনুল খাত্তাব মসজিদ’ হলো স্থানীয় সম্প্রদায়ের অনিবার্য শক্তির একটি বড় প্রমাণ। নজরকাড়া মার্বেল পাথরে নির্মিত মসজিদটি দক্ষিণ আমেরিকার মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম। ১৯৯৭ সালে মাইকাওয়ে আরব সম্প্রদায়ের শক্ত অবস্থানের প্রতীক হিসেবে নির্মিত হয়। মাইকাওয়ের মুসলিম সম্প্রদায়ের একজন গবেষক পেদ্রো ডেলগাডো মসজিদটিকে মাইকাও শহরের প্রতীক হিসেবে আখ্যায়িত করেন। মসজিদটিতে একসঙ্গে ৭০০ মুসল্লির নামাজ পড়ার ব্যবস্থা আছে।

মসজিদটির গা ঘেঁষে দারুল ইকরাম স্কুল হলো- মাইকাওয়ের মুসলিম সম্প্রদায়ের আরেকটি প্রতীক। এক হাজারেরও বেশি ছাত্র নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি একসময় ছিল মাইকাওয়ের আরব মুসলিম এবং মুসলিম অভিবাসীদের গর্বের বস্তু। বিস্তৃতি ছিল আরও দুটি সেন্টারে। তবে চলতি বছর স্কুলটির ছাত্রসংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ২৫২ জনে। সেন্টার কমে হয়েছে একটি। এসব ছাত্রের অর্ধেকের শিকড়ই আরবে নয়।

১৯৮৭ সাল থেকে মাইকাওয়ে বসবাসকারী লেবানিজ নাগরিক ও দোকান মালিক নাসের গেবারা বলেন, ‘আমাদের এখন সময় ভালো যাচ্ছে না। আমাদের সম্প্রদায় কঠিন সংকট মোকাবেলা করছে। শহরটির প্রতি আমার ভালোবাসা আমার রক্তের সঙ্গে মিশে গেলেও আমি অসংখ্যবার লেবাননে ফিরে যাওয়ার কথা ভেবেছি। পাশাপাশি এ-ও ভেবেছি, মাইকাও শহরের প্রতি আমার ভালোবাসা ছড়িয়ে পড়েছে রক্তের প্রতিটি কণিকায়।’

দারুল ইকরাম স্কুল, ছবি: সংগৃহীত

মাইকাও শহরে এখনো যেসব মুসলিম ও আরব সম্প্রদায় টিকে আছেন; তারা একটি বিশেষ আবেগকে ভাগাভাগি করেন। নির্দিষ্ট একটি জায়গার প্রতি আনুগত্য তাদের যেমন অনেক কিছু দিয়েছে; তেমনি নিয়েছেও অনেক কিছু। কলম্বিয়া এবং বিশেষ করে মাইকাওয়ের আরব সম্প্রদায়ের বেড়ে ওঠা বুঝতে হলে কাউকে ফিরে যেতে হবে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে।

এ অঞ্চলে আরবদের অভিবাসন একেবারে ১৮৮০ সালের দিকের, যখন মধ্যপ্রাচ্যের অনেকেই অভিবাসন করেছেন অটোমান সাম্রাজ্য থেকে। যখন অটোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটে; তখন কিছুসংখ্যক আরব উত্তর কলম্বিয়াকে তাদের গন্তব্য বানান। বারানকুইল্লা ও মাইকাওয়ের মতো শহরের দিকে ধাবিত হন। তারা তা করলেন তাদের প্রাথমিক প্রবেশ পথ ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের বন্দরগুলো থেকে। ১৯৭০ সালে লেবাননে গৃহযুদ্ধ দেখা দিলে অনেক লেবানিজ নাগরিক অভিবাসনের সিদ্ধান্ত নেন। তাদের অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান এবং সামান্য একটি অংশ চলে যায় কলম্বিয়ায়।

ওমর ইবনুল খাত্তাব মসজিদে নামাজের দৃশ্য, মাইকাও, কলম্বিয়া, ছবি: সংগৃহীত

পরে আরব মুসলিম সম্প্রদায় ধীরগতিতে কিন্তু দৃঢ়তার সঙ্গে মাইকাওয়ে নিজেদের অবস্থান তৈরি করে। তবে এই সেটা সময় চিরস্থায়ী হয়নি। একসময় প্রতিবেশী ভেনেজুয়েলার অর্থনীতিতে ধস নামে। ২০০০ সালের প্রথমদিকে দেশটি ধাবিত হয় বড় ধরনের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংকটের দিকে। খুব স্বাভাবিকভাবেই ধাক্কা এসে লাগে মাইকাওয়ের ওপর। একসময় যে অঞ্চলে অফুরন্ত অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ছিল, তা পড়ে স্থবিরতার কবলে। ফলে উদীয়মান আরব অভিবাসীরা অন্যত্র নিজেদের ভাগ্য অনুসন্ধান শুরু করে।

আরব সম্প্রদায়, তাদের মসজিদ, স্কুল এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সীমিত হয়ে এসেছে। যে সম্প্রদায় একসময় যেকোনো জায়গায় ৫ হাজার থেকে ৮ হাজার ছিল তাদের সংখ্যা। এখন এক হাজারের নিচে যদিও। তবে পুরোপুরি সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ করা মুশকিল।

স্থানীয় দারুল ইকরাম স্কুলের ডিরেক্টর জর্জ মেনডোজা বলেন, ‘মাইকাও একটি সংকটের মধ্য দিয়ে গেছে। যা এখানকার বাণিজ্যকে প্রভাবিত করেছে। ব্যবসায়ীদের অধিকাংশই ছিলো আরব, যাদের অনেকেই সুযোগের সন্ধানে অন্যত্র চলে গেছে ছেলেমেয়েদের নিয়ে। আর এর প্রভাব পড়েছে স্কুলের ওপর।’

এত কিছুর পরও তারা মূল জনগোষ্ঠীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। অনেক কম শিশুকে এখন দারুল ইকরাম স্কুলের করিডোরে দেখা যায়। যদিও একসময় পরিপূর্ণ থাকা মসজিদের প্রার্থনা কক্ষের সামান্য জায়গাই ভরে যেত। তারপরও মাইকাওয়ের মুসলিম সম্প্রদায় এখানকার মৌলিক জনগোষ্ঠীর অংশ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর