সিলেটের উছমানপুর জামে মসজিদ। অনেকের কাছে এটি ‘গায়েবি মসজিদ’ হিসেবে পরিচিত। প্রায় পাঁচ শ বছর আগে সুলতানি আমলে নির্মিত এই মসজিদটিকে ঘিরে নানা মিথ আছে। আয়তনে খুব ছোট এই মসজিদে নামাজ পড়তে পারেন মাত্র ৫০ জন। সুলতানি আমলে ১৫৩০ থেকে ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মসজিদটি নির্মিত হয়।
প্রচলিত আছে, একসময় মসজিদটি টিলা ও জঙ্গলের আড়ালে হারিয়ে যায়। দীর্ঘদিন পর জঙ্গল ও টিলা কেটে মসজিদ আবার পুনরুদ্ধার করা হয়। সেই থেকে এটি ‘গায়েবি মসজিদ’ নামে পরিচয় পায়।
মসজিদটি দেখতে অনেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসে। জানা গেছে, একসময় নবাব আলীবর্দী খান এবং পরে সুবাদার নজমুদ্দৌলা মীর নজমুদ্দীন আলী খান মসজিদের ব্যয় নির্বাহের জন্য গ্রামের বিশিষ্টজন সৈয়দ খয়রুল্লাহকে ১৮০১ সালে সনদের মাধ্যমে (ফারসি ভাষার সনদ জেলা কালেক্টরেটে সংরক্ষিত আছে) কিছু জমি দান করেন, যাতে জমির আয় দিয়ে মসজিদ পরিচালনা করা যায়। পরবর্তী সময়ে খয়রুল্লাহর বংশধররা ১৯৯৫ সালে মসজিদসহ মসজিদের ভূ-সম্পত্তি ওয়াকফ তালিকাভুক্ত করেন।
ওসমানীনগরের উছমানপুরের গায়েবি মসজিদটি চতুর্ভুজ আকৃতির। এর দৈর্ঘ্য ৩২ ফুট ও প্রস্থ ৩২ ফুট। চতুর্ভুজ আকৃতির হলেও ওপর দিকে উঠতে উঠতে ক্রমেই গোল হয়ে গম্বুজের সঙ্গে গিয়ে মিশেছে এর কাঠামো। মসজিদের দেয়াল ও ছাদে প্রাচীন আমলের নকশার কারুকাজ। দুই দিকে একটি করে জানালা এবং পূর্ব দিকে বিশাল প্রবেশ দ্বারের সঙ্গেই দুই পাশে আরো দুটি ছোট প্রবেশ দ্বার আছে। নানা গবেষণা ও স্থাপত্যবিদদের পর্যালোচনা বলছে, এটি সুলতানি আমলের মসজিদ।
শুধু সিলেটে নয়, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আছে কথিত অনেক গায়েবি মসজিদ। যেমন- দীর্ঘদিন পর আবিষ্কৃত হওয়া ময়মনসিংহের নান্দাইলের মুশুল্লি ইউনিয়নের নগরকুচুরী গ্রামে প্রায় এক হাজার ২০০ বছর আগের গায়েবি মসজিদে সহসাই ভেসে এলো আজানের ধ্বনি। লোকবিশ্বাস, শাহ সুলতান কমরুদ্দিন রুমির (রহ.) সময়ে মসজিদটি অলৌকিকভাবে তৈরি হয়। এটি লোকবিশ্বাসের গায়েবি মসজিদ। মসজিদের আছে পুরনো শিল্পসুষমা, ইটগুলো সাধারণের চেয়ে ভিন্ন আকৃতির এবং দেয়ালের প্রস্থ দেড় হাত।
রাজবাড়ীর কালুখালী উপজেলার রতনদিয়া ইউনিয়নের রূপসা গ্রামে আছে গায়েবি মসজিদ। মসজিদসংলগ্ন মাজার থেকে অনুমিত, কোনো এক দরবেশ ইবাদতের জন্য সবার অলক্ষে মসজিদটি নির্মাণ করেন। লোকবিশ্বাস- এখানের মসজিদ, মাজার গায়েবিভাবে তৈরি হয়েছে।
বরিশালের বাকেরগঞ্জে আছে নিয়ামতি গায়েবি মসজিদ। জনশ্রুতি আছে, প্রায় ২০০ বছর আগে জিনেরা এক রাতে মসজিদটি তৈরি করে দেয়।
কিশোরগঞ্জের গুরাই ইউনিয়নের শাহি মসজিদ ৪০০ বছরের প্রাচীন এবং লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, মসজিদটি গায়েবিভাবে নির্মিত।
জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার চিকাজানি এলাকায় ৫০০ বছর আগে গড়ে ওঠে একটি গায়েবি মসজিদ। জানা যায়, এলাকায় আগত কোনো এক পীর-ফকির ইবাদতের জন্য নির্জনস্থান বেছে নেন, তার অলৌকিক ক্ষমতায় এক রাতে মসজিদটি নির্মিত হয়ে যায়।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার ছোট কুমিরা ইউনিয়নের মসজিদ্দা গ্রামের হাম্মাদিয়া মসজিদ, চট্টগ্রামের দ্বিতীয় প্রাচীন মসজিদ। কে বা কারা কবে মসজিদটি বানিয়েছে- তা কারো জানা নেই, তাই গোলাপি রঙের এ মসজিদটিকে সাধারণ মানুষ গায়েবি মসজিদ হিসেবে জানে।
ফটিকছড়ি উপজেলার হারুয়ালছড়ি ইউনিয়নের ফকিরপাড়ায় আছে একটি গায়েবি মসজিদ। প্রায় সাড়ে ৩০০ বছর আগে মোগল আমলের কিছু সুফিসাধক মসজিদটি নির্মাণ করেন।
ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার বান্দুরা গ্রামে আছে প্রায় ৪০০ বছরের প্রাচীন ভাঙা মসজিদ। সুবেদার ইসলাম খাঁ ১৬১৫ সালে এখানে একটি শাহি মসজিদ নির্মাণ করালেও তা কালেরগর্ভে হারিয়ে যায়। ১৮৮০ সালে সহসাই মসজিদটির সন্ধান মেলে। তখন থেকেই মসজিদটি পরিচিত ভাঙা মসজিদ, গায়েবি মসজিদ নামে।
কথিত আছে, জিলাদপুরে (মৌলভীবাজার, শ্রীমঙ্গল) মসজিদ বানানোর জমিতে মাপজোখ করতে করতেই সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে যায়। কিন্তু পরের দিন সকালে সবাই দেখে সেখানে সুন্দর একটি মসজিদ তৈরি হয়ে গেছে। হাজার বছরের প্রাচীন এ মসজিদটি এলাকাবাসীর কাছে গায়েবি মসজিদ ও অলৌকিকত্বের প্রতীক।
প্রায় ২০০ বছর আগের কথা, সীতাকুণ্ডের বারৈয়াঢালা ইউনিয়নের দারোগারহাটের কৃষক আবদুল গফুর শাহের পেশা ছিল গরু-বাছুর পালন। একদিন তার একটি বাছুর পাহাড়ে হারিয়ে গেলে তা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। অনেক দিন পর পাহাড়ের উঁচুস্থান থেকে বাছুরের ডাক শুনে গফুর গিয়ে দেখেন সেখানে একটি নামাজের স্থান। জনমানবহীন এ স্থানে কে নামাজ আদায় করেন, এ রহস্য ক্রমে ঘনীভূত হয়। তখন তিনি সেখানে একটি মসজিদ তৈরি করলেন। এরপর পাহাড় থেকে নিয়মিত আজানের ধ্বনি শোনা যেত। এভাবেই মসজিদটির নাম হয় গায়েবি মসজিদ।
ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার বারোবাজারে রয়েছে সুলতানি আমলের ১৯টি মসজিদ। ৭০০ বছরের প্রাচীন এমসজিদগুলো মাটিচাপা পড়ে ছিল, এখনো সাতটি মসজিদ রয়েছে মাটির নিচে। মসজিদগুলোর অন্যতম- সাতগাছিয়া আদিনা মসজিদ, গলাকাটা মসজিদ, হসিলবাগ মসজিদ, নুনগোলা মসজিদ, জোড় বাংলা মসজিদ ইত্যাদি। এই মসজিদগুলো এলাকায় বারোবাজার মাটির নিচের গায়েবি মসজিদ নামে পরিচিত। মসজিদগুলোর প্রত্ন ও পর্যটন গুরুত্ব রয়েছে।
বাংলাদেশে গায়েবি মসজিদের তালিকা সুদীর্ঘ। যেমন- দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের সুরা মসজিদ, ঝিনাইদহের পাঠাগার মসজিদ, পীরপুকুর মসজিদ, ঠাকুরগাঁওয়ের মেদিনি সাগর এককাতার গায়েবি মসজিদ, ফরিদপুরের রায়নগর আউলিয়া গায়েবি মসজিদ, হবিগঞ্জের উচাইল শংকরপাশা শাহি মসজিদ ইত্যাদি।
বস্তুত ‘মসজিদ’ আল্লাহর ঘর। নির্মাণরহস্য ও হারিয়ে যাওয়ার পর নতুনভাবে আবিষ্কৃত হওয়ার কারণে হয় গায়েবি মসজিদ। মুসলিম ঐতিহ্য, স্থাপত্যকৌশল, বিজয়স্মারকসহ বহুবিধ উজ্জ্বলতায় মসজিদ অনন্য। পবিত্র কোরআনের ভাষায় ‘নিশ্চয়ই মসজিদসমূহ আল্লাহর।’ -সুরা জিন : ১৮