বাংলাদেশের এমন এক ইঞ্চি জায়গা নেই যেখানে বৈষম্য নেই। আমাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান একদিকে ন্যায়বিচার ও সুষম বন্টনের কথা বলে আবার নিজেরাই বৈষম্যের মূর্তপ্রতীক। কেউ ন্যায়বিচারের কথা বললে সে আরও মারাত্মকভাবে বৈষম্যের শিকার হয়। দেশের পরতে পরতে ও স্তরে স্তরে বৈষম্যে পরিপূর্ণ। এটি এখন এমনি মামুলি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, এখানে এটাকে কেউ আর অপরাধ বলে ঘৃণা তো দূরের কথা সামান্য আফসোসও করে না।
দেশের ছাত্র-জনতা চাকরির ক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতিকে বৈষম্য বলে একটি ফ্যাসিস্ট সরকারকে উৎখাতই করে ফেললো। অথচ বাংলাদেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের সর্বত্র বৈষম্যের পাহাড় জমা হয়েছে। এগুলোর জন্য কেউ কোনোদিন আন্দোলন-সংগ্রাম করে না। কেউ নিয়তির খেলা বলে চালিয়ে দেন, কেউ চাকরি যাওয়ার ভয়ে কিছু বলেন না, কেউ অনিয়মকে নিয়ম হিসাবেই জানেন।
বাংলাদেশকে বৈষম্যহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা আদৌ সম্ভব নয় বলে মনে করেন কেউ কেউ। কারণ এমন একটি প্রতিষ্ঠান চোখে পড়ে না যেখানে বৈষম্য নেই। বৈষম্যহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নপূরণের অঙ্গীকার নিয়ে দায়িত্ব নেওয়া বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে আগামী ১০০ বছরেও বৈষম্য দূর করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বৈষম্য এমনভাবে শিকড় গেড়েছে যাকে উপড়ে ফেলা এত সহজ নয়।
নতুন সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে একের পর এক বৈষম্যের শিকার মানুষগুলো বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে রাস্তায় নেমেছে। আরও কত প্রতিষ্ঠান বৈষম্যের যাঁতাকলে পিষ্ঠ তার কোনো হিসাব নেই। তাদের কথা শোনার কেউ নেই। এই অসহায়দের কান্না কঠিন দেয়াল ভেদ করে বাইরে খুব একটা আসে না, আসা সম্ভব হয় না।
সত্যিকারার্থে বৈষম্যের মূল উৎপাটনের জন্য মানুষের চরিত্র পরিবর্তন করতে হবে। একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কিংবা ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক কর্তৃপক্ষ যদি নৈতিক মানবিক গুণে গুণান্বিত হন, তবে তাদের প্রতিষ্ঠানে যেমন বৈষম্য থাকতে পারে না, তেমনিভাবে রাষ্ট্র-সরকার যদি সৎ ও নৈতিক মানবিক গুণসম্পন্ন ব্যক্তি দ্বারা পরিচালিত হয়, তবে তাদের প্রধান কর্মসূচি হবে একটি বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।
কারণ ইসলামের আগমনই ঘটেছে একটি বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করতে। জাতি হিসাবে আমাদের পরিচয় সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি, তোমাদের কর্মক্ষেত্রে আনা হয়েছে মানুষের কল্যাণের জন্য। তোমরা ভালো কাজের হুকুম দেবে এবং দুষ্কৃতি থেকে বিরত রাখবে।’ -সুরা আলে ইমরান: ১১০
আয়াতটি অত্যন্ত বিশদ ব্যাখ্যা সম্বলিত। আয়াতে উল্লেখিত জাতি মানে মুসলিম জাতি। এটি সেই সময়কার আয়াত যখন পৃথিবীর বুকে শ্রেষ্ঠ জাতি বলতে বনি ইসরাঈলকে বুঝানো হতো। কোরআনে কারিমের সুরা বাকারায় বেশ কয়েকবার ওই জাতির শ্রেষ্ঠত্বের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু তাদের অযোগ্যতার কারণে বনি ইসরাঈলদের দুনিয়ার নেতৃত্ব ও পথপ্রদর্শনের আসন থেকে নামিয়ে মুসলিম জাতিকে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। কারণ নৈতিক চরিত্র ও কার্যকলাপের দিক দিয়ে এখন মুসলিমরাই দুনিয়ার সর্বোত্তম মানবগোষ্ঠী। সৎ, ন্যায়নিষ্ঠ ও মানবতার কল্যাণমূলক কাজ করার মতো যোগ্যতা ও নেতৃত্ব তোমাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়ে গেছে। অর্থাৎ মুসলিমদের মধ্যে ন্যায় ও সৎবৃত্তি প্রতিষ্ঠা এবং অন্যায় ও অসৎবৃত্তির মূলোৎপাটন করার মনোভাব ও কর্মস্পৃহা সৃষ্টি হয়ে গেছে। আর এই সঙ্গে তারা এক ও লা-শরিক আল্লাহকেও বিশ্বাসগত দিক দিয়ে এবং কার্যত নিজেদের ইলাহ, রব ও সর্বময় প্রভু বলে স্বীকার করে নিয়েছে। কাজেই ইসলামের নেতৃত্ব বনি ইসরাঈলদের থেকে নিয়ে মুসলিম উম্মাহকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মুসলিমরাও আজ ইসরাঈলিদের মতোই আচরণ শুরু করেছে। ফলে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে তারা। অথচ রাষ্ট্রক্ষমতা ছাড়া বৈষম্য উৎপাটন করা সম্ভব নয়।
মানবতার কল্যাণের জন্য নেক কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের মাধ্যমে বৈষম্যকে দূর করতে হবে। এই দায়িত্ব পালন করার জন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ইসলামের হাতে তুলে দিতে হবে। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোর সর্বত্র বৈষম্য একটি অসৎ কাজ। পক্ষান্তরে একটি বৈষম্যহীন সুষম ও ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ তৈরি অবশ্যই একটি সৎ কাজ। এই বৈষম্য দূর করার ক্ষমতা ইসলাম ছাড়া অন্যকোনো জীবন ব্যবস্থার কাছে নেই। এই ব্যবস্থা শুধু ইসলামের হাতেই আছে। কারণ ইসলাম ভারসাম্যপূর্ণ জীবন ব্যবস্থার নাম। ইসলাম একটি উৎকৃষ্ট ও উন্নত মর্যাদাসম্পন্ন জীবন ব্যবস্থা যা ইনসাফ, ন্যায়নিষ্ঠা ও ভারসাম্যের নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত, দুনিয়ার নেতৃত্ব লাভের জন্য এ ব্যবস্থাই একমাত্র যোগ্যতা রাখে, সত্য ও সততার ভিত্তিতে সবার সঙ্গে যার সম্পর্ক সমান এবং কারোর সঙ্গে যার কোনো অবৈধ ও অন্যায় সম্পর্ক থাকে না।
আগেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশ বৈষম্যে পরিপূর্ণ একটি দেশ, যার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বৈষম্য শিকড় গেড়ে আছে। এটাকে উপড়ে ফেলা কারো পক্ষে সহজ নয়। একমাত্র ইসলামই পারে একটি বৈষম্যমুক্ত সমাজ উপহার দিতে। এজন্য দেশের শাসন ক্ষমতা সৎ ও নিষ্ঠাবান লোকদের হাতে অর্পণ করতে হবে, যারা ক্ষমতা হাতে পেয়ে চারটি কাজ করবে। কোরআন মাজিদ বলছে, ‘এরা এমন লোক যাদেরকে আমি যদি পৃথিবীতে কর্তৃত্ব দান করি তাহলে এরা নামাজ কায়েম করবে, জাকাত দেবে, ভালো কাজের আদেশ দেবে এবং খারাপ কাজ নিষেধ করবে। আর সমস্ত বিষয়ের পরিণাম আল্লাহর হাতে।’ -সুরা হজ : ৪১
এই চারটি কাজ রাষ্ট্রের সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠালাভ করবে। এগুলোর প্রতিষ্ঠাই সে সরকারের প্রথম প্রধানতম কাজ। কোনো সমাজে যখন উল্লেখিত চারটি কাজ চলতে থাকে- তখন মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় সবক্ষেত্র থেকে বৈষম্য বিদায় নেবে। এ সব সৎ মানুষদের হাতে যখন ক্ষমতা আসে তখন তারা ব্যক্তিগত জীবনে ফাসেকি, দুষ্কৃতি, অহংকার ও আত্মম্ভরিতায় মশগুল হওয়ার পরিবর্তে নামাজ কায়েম করবে। নামাজের মাধ্যমে ব্যক্তিগত ও সামাজিক বৈষম্য দূরীভূত হয়।
কারণ নামাজের প্রভাবে মানুষ খারাপ ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত থাকে। তাদের ধন-সম্পদ বিলাসিতা ও প্রবৃত্তি পূজার পরিবর্তে জাকাত দানে ব্যয়িত হবে। এর ফলে মানুষের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর হবে। তাদের রাষ্ট্রযন্ত্র সৎ কাজকে দাবিয়ে রাখার পরিবর্তে তাকে বিকশিত ও সম্প্রসারিত করা দায়িত্ব মনে করবে। তাদের শক্তি অসৎ কাজকে ছড়ানোর পরিবর্তে দমন করার কাজে ব্যবহৃত হবে।
এ ধরনের একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থা যতদিন না প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত এই সমাজ থেকে বৈষম্য দূর করা আদৌ সম্ভব নয়। ব্যক্তিগতভাবে মানুষ নামাজ, রোজা, জাকাত ও হজ পালনকারী হলেও বৈষম্য দূর হবে না। রাষ্ট্রে ইসলাম কায়েম না করে সর্বক্ষেত্রে ব্যক্তিগতভাবে যতই ইসলাম পালন করুন না কেন, বৈষম্য দূরীভূত হওয়া সম্ভব নয়।
লেখক: ইসলামবিষয়ক গবেষক।