পবিত্র কোরআনে আল্লাহতআয়ালা ঋণদাতার ফজিলত বর্ণনা করে বলেন, ‘কে এমন আছে, যে আল্লাহকে কর্জে হাসনা বা উত্তম ঋণ দেবে এরপর তিনি তার জন্য তা বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেবেন এবং তার জন্য রয়েছে সম্মানিত পুরস্কার।’ -সূরা আল হাদিদ: ১১
বর্ণিত আয়াতে আল্লাহতায়ালাকে ঋণ দেয়ার অর্থ হচ্ছে তার বান্দাদের ঋণ দিয়ে তাদের অভাব মোচন করা। কেউ যদি মানুষের প্রতি করুণা করে তাহলে আল্লাহতায়ালাও তার প্রতি করুণা করবেন।
হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কোনো মুসলমান অন্য মুসলমানকে একবার ঋণ (কর্জে হাসানা) দিলে তা মহান আল্লাহর পথে সে পরিমাণ সম্পদ দু’বার সাদাকা করার সমতুল্য।’
কোরআনে কারিমে আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘আর ঋণগ্রহীতা যদি অভাবগ্রস্থ হয়, তবে তাকে স্বচ্ছলতা আসা পর্যন্ত সময় দেওয়া উচিত। আর যদি ক্ষমা করে দাও তবে তা তোমাদের জন্য খুবই উত্তম যদি তোমার উপলব্ধি করতে পারতে।’ -সূরা আল বাকারা: ২৮০
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) এক ব্যক্তিকে এভাবে উপদেশ দিয়েছেন, ‘গোনাহ কম করো তোমার মৃত্যু সহজ হবে, ঋণ কম করো; স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতে পারবে।’
বিনা প্রয়োজনে ঋণ গ্রহণ করা এবং পাওনা পরিশোধে টালবাহানা করা মারাত্মক অপরাধ এবং ঋণদাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের নামান্তর।
এক হাদিসে ঋণ গ্রহণের নিন্দা করা হয়েছে এবং ঋণ গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই দুই রকম হাদিসের মর্মার্থ হলো- বিনা প্রয়োজনে ঋণ গ্রহণ করা নিন্দনীয়। সুতরাং এর থেকে বিরত থাকা উচিত।
একান্ত প্রয়োজন ব্যতিত ঋণ গ্রহণ করা মোটেই ঠিক নয়। তবে অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজনে ঋণ নেওয়া যেতে পারে। আর এসব ব্যাপারে ঋণ নিলে আল্লাহতায়ালা সেই ঋণ আদায়ে সাহায্য করেন।
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আমি জান্নাতের দরজায় লেখা দেখেছি যে, সাদাকা দিলে দশ গুণ সওয়াব পাওয়া যায় আর ঋণ (লাভমুক্ত ঋণ) প্রদান করলে আঠারো গুণ সওয়াব পাওয়া যায়।
বলা হয়েছে, সদকা প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও চাওয়া হয়, আর ঋণ চাওয়া হয় শুধু প্রয়োজনের কারণে। এটাই স্বাভাবিক অবস্থা তাছাড়া কারও প্রয়োজন পূর্ণ করে দিলে সে ব্যক্তি যে পরিমাণ খুশি হয় তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এ জন্য ঋণ দেওয়া অনেক বেশি সওয়াবের কাজ।
আল্লাহতায়ালা যখন কাউকে অপমাণিত করতে চান, তখন তার ঘাড়ে ঋণের বোঝা চাপিয়ে দেন। ঋণগ্রস্থ ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করলে তার জান্নাতে প্রবেশ হওয়ার বিষয়টি স্থগিত হয়, যতক্ষণ না তার ঋণ আদায় করা হয়।
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, ‘শহীদদের সমস্ত গোনাহ মাফ করা হয়, কিন্তু ঋণ মাফ করা হয় না।’ ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে বিলাসিতা বর্জন করা উচিত এবং মেহমান অতিথি আসলেও তাদের জন্য ঋণ করে মেহমানদারী করা ঠিক না।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যদি কোনো ব্যক্তি তোমাদের কাউকে ঋণ দেয়, ঋণী ব্যক্তি যেন তাকে উপহার না দেয়। স্ত্রীর মোহরানা বাকী থাকলেও এই মোহরানাও ঋণের অন্তর্ভুক্ত হবে। তাই যে ব্যক্তি ঋণগ্রস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করবে সে বড়ই দুর্ভাগা।
সহিহ বোখারির এক হাদিসে নবী করিম (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তির কাছে কারও কোনো পাওনা থাকে তার উচিত দুনিয়াতেই তা পরিশোধ করা অথবা মাফ করিয়ে নেওয়া। নতুবা কিয়ামতের দিন দিরহাম দিনার, টাকা-পয়সার কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। কারো কোনো দাবি থাকলে তা নিজের সৎকর্ম দিয়ে পরিশোধ করা হবে। সৎকর্ম শেষ হয়ে গেলে পাওনাদারদের গোনাহ প্রাপ্য অর্থ পরিমাণে তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে।
বাংলাদেশে অনেক বেসরকারি সংস্থা রয়েছে। যারা দারিদ্র বিমোচনের লক্ষে ঋণ দিয়ে থাকেন। এসব সংস্থা ১ বছর বা দু’বছর মেয়াদি ঋণ দিয়ে সাপ্তাহিক বা মাসিক কিস্তির মাধ্যমে ঋণ তুলে নেন। তাতে দেখা যায়, ঋণে সুদের পরিমাণ ২২ থেকে ৩৫ ভাগ হচ্ছে। ঋণ সময়মতো না দিলে ঋণ গ্রহিতাকে অপমান ছাড়াও ঘরের আসবাবপত্র, চালের টিন প্রভৃতি খুলে নিয়ে যেতে দ্বিধাবোধ করে না।
ঋণ নিয়ে এভাবে ১০ থেকে ২০ ভাগ লোকের ভাগ্যের পরিবর্তন হলেও বাকী ৮০ ভাগ লোক স্বাবলম্বী হতে পারে না। বরং ঋণ গ্রহিতারা সুদ দিতে দিতে তাদের সহায় সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যান।
আমাদের কথা হলো, সমাজের উন্নয়ন তখনই হবে, যখন সুদমুক্ত ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা হবে। সুদ মানুষের মধ্যে নির্মমতা, সংকীর্ণতা, স্বার্থপরতা, কৃপণতা, নৃশংসতা ও নিষ্ঠুরতার জন্ম দেয়। সুদ মানুষের উন্নত চরিত্র গঠনের প্রতিবন্ধক। সুদ মানুষের জ্ঞান বৃদ্ধি ও মেধা বিকাশের অন্তরায়। অতএব এটা থেকে বেঁচে থাকা সবার নৈতিক দায়িত্ব।