পৃথিবীটা এখন অনেক বদলে গেছে। মানুষ আধুনিকতার ছোঁয়ায় উন্নত জীবনের অধিকারী হলেও চরিত্র হয়ে গেছে হিংস্র থেকে হিংস্রতর। শিশু হত্যা, শিশু-ধর্ষণ ও মানুষের মুণ্ডু কাটার আদিম বর্বরতার মতো কাজ সমাজের মানুষকে দেখতে হচ্ছে, শুনতে হচ্ছে। নানাভাবে গুজব সৃষ্টি করে একটি চক্র মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে, অন্যদিকে ছেলেধরা সন্দেহে রাস্তায় উত্তেজিত জনতার হাতে প্রাণ হারাচ্ছে সাধারণ মানুষ। উত্তেজিত ও অসহিষ্ণু জনতা সন্দেহজনক ব্যক্তিদের পিটিয়ে হত্যার মতো নির্মমতার জন্ম দিচ্ছে। কোনো সভ্য সমাজে এমন ঘটনা অপ্রত্যাশিত-অনাকাঙ্খিত। এটা ভাবাও যায় না।
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বিদায় হজের ভাষণে বলেছেন, ‘তোমাদের রক্ত তথা জীবন ও সম্পদ পরস্পরের জন্য হারাম; যেমন আজকের এই দিনে, এই মাসে ও এই শহরে অন্যের জানমালের ক্ষতিসাধন করা তোমাদের ওপর হারাম।’
সাম্প্রতিক সময়ে সন্দেহের বশবর্তী হয়ে, গুজবের হুজুগে পড়ে পিটিয়ে মানুষ হত্যার মতো বীভৎস ঘটনা ঘটছে। অথচ হত্যা এমন একটি জঘন্য অপরাধ, যা আল্লাহর কাছে কঠিন ও মারাত্মক গোনাহ হিসেবে বিবেচিত। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘দুনিয়া ধ্বংস করে দেওয়ার চেয়েও আল্লাহর কাছে ঘৃণিত কাজ হলো মানুষ হত্যা করা।’ – তিরমিজি
ইসলাম মনে করে, একজন নিরীহ ও নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা গোটা মানবজাতিকে হত্যা করারই নামান্তর। আর কোন ব্যক্তি যদি কারও প্রাণ রক্ষা করে, সে যেন পৃথিবীর সব মানুষের প্রাণ রক্ষা করল। তাই তো অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যাকে সবচেয়ে বড় গোনাহ বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে নরহত্যার ভয়ানক পরিণাম সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘নরহত্যা বা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি ছাড়া কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন দুনিয়ার সমগ্র মানবগোষ্ঠীকে হত্যা করল; আর কেউ কারও প্রাণ রক্ষা করলে সে যেন পৃথিবীর সমগ্র মানবগোষ্ঠীকে প্রাণে রক্ষা করল।’— সূরা আল মায়িদা: ৩২
পরিবারের কোনো সদস্যকে অন্যায়ভাবে মারা হলে গোটা পরিবারের ওপরই নেমে আসে শোকের ছায়া। আজীবন তারা এ শোক বয়ে বেড়ায়। তা ছাড়া পারিবারিক, সামাজিক ও আর্থিক নানাবিধ সমস্যা তাদের ওপর চেপে বসে। সর্বোপরি মাতৃ ও পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হয় নিহতের সন্তান-সন্ততিরা। বিধবা হয় স্ত্রী অথবা স্বামী হয় স্ত্রীহারা। মা-বাবা হারান তাদের প্রিয় সন্তান। এর চেয়ে বড় অন্যায় আর কী হতে পারে?
কিয়ামতের দিন নরহত্যার বিচার করা হবে সর্বাগ্রে, তারপর অন্যসব অপরাধের শাস্তি হবে। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন মানুষের মধ্যে সর্বপ্রথম যে মোকদ্দমার ফায়সালা হবে, তা হলো হত্যা সম্পর্কিত।’
মানবতা ও নৈতিকতার কোনো স্তরেই নিরপরাধ মানুষের প্রাণহানি ও অহেতুক রক্তপাত সমর্থনযোগ্য নয়। মানুষের জীবনের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পবিত্র কোরআনে সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ যার হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন যথার্থ কারণ ব্যতিরেকে তোমরা তাকে হত্যা করো না।’— সূরা বনি ইসরাইল: ৩৩
ইসলাম বলেছে, সব গোনাহ ক্ষমা করলেও হত্যাকারীকে আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। হত্যাকৃত ব্যক্তি ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, যুবক-বৃদ্ধ- যেই হোক না কেন, হত্যাকারীকে এর শাস্তি পেতেই হবে। হাদিসে এ বিষয়ে নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যদি আসমান-জমিনের সব অধিবাসী একজন মুসলমানকে অবৈধভাবে হত্যা করার জন্য একমত পোষণ করে, তবে আল্লাহ তাদের সবাইকে অবশ্যই জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।’— মুসনাদে আহমাদ
গণপিটুনি কোনো বিচার ব্যবস্থা কিংবা সমাধান নয়, বরং এটি মারাত্মক অপরাধ ও গোনাহের কাজ। এখানে অনেকগুলো পাপের কাজ একসঙ্গে সংঘটিত হয়। তাই ইসলাম এমন কাজকে হারাম করেছে।
সমাজে কোনো রকম অশান্তি সৃষ্টি, নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা, হানাহানি, উগ্রতা, গুজব, বর্বরতা, সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ড কোনো বিবেকবান ও ধর্মপ্রাণ মানুষের কাম্য নয়। তাই আমরা আশা করি, সরকার গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক কাজে লাগিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যথা শিগগির গুজব সৃষ্টিকারী চক্রকে খুঁজে বের করতে সক্ষম হবে। আমরা মনে করি, গণপিটুনি ও আইন হাতে তুলে নেওয়ার মাধ্যমে ঘটনার কোনো সমাধান হয় না। এ ক্ষেত্রে নিরপরাধ মানুষও উত্তেজিত জনতার হঠকারিতার শিকার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। যা ইতোমধ্যে ঘটেও গেছে। এমনটা খুবই দুঃখজনক ও নির্মম।