মাকামে ইবরাহিমের মর্যাদা

হজ, ইসলাম

ইসলাম ডেস্ক, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম | 2023-08-30 09:38:12

মক্কা (সৌদি আরব) থেকে: পবিত্র কাবা ঘর থেকে ১০ বা ১১ মিটার পূর্ব দিকে সাফা-মারওয়া অভিমুখে অবস্থিত একটি সোনালী রংয়ের মিনার দৃষ্টি কাড়ে সবার। এটাই মাকামে ইবরাহিম। এর ভেতরে একটি পাথর খণ্ড রয়েছে, যে পাথর খণ্ডে দু'টো পায়ের ছাপ বিদ্যমান।

এই পাথরটি নরম প্রকৃতির পাথর, কঠিন শিলা খণ্ড নয়। এর দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা প্রায় পঞ্চাশ সেন্টিমিটার। প্রায় চৌকোণ বিশিষ্ট। পাথরটি আগে উন্মুক্ত ছিল, যে কেউ হাত দ্বারা স্পর্শ করতে পারত। কিন্তু পরবর্তীতে তা সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে অত্যন্ত সুদর্শন ও মজবুত লোহা ও কাঁচের বেষ্টনীর ভেতর একটি ক্রিস্টালের বাক্সে রাখা হয়েছে। এটা ধরা, স্পর্শ করা, চুমো খাওয়া, তাতে কোনো কাপড় মুছে আনার কোনো আলাদা উপকারিতা নেই। তারপরও অনেক তাওয়াফকারী কাজগুলো করে থাকেন। এগুলো ভুল কাজ। ইসলামি শরিয়ত এসব করার অনুমতি দেয় না।

মাকামে ইবরাহিম। অর্থ হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের দাঁড়ানোর স্থান। এটি একটি জান্নাতের অতি মূল্যবান ইয়াকুত পাথর। এ বিষয়ে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমি বলতে শুনেছি; হাজরে আসওয়াদ ও মাকামে ইবরাহিম জান্নাতের দু'টো ইয়াকুত পাথর। আল্লাহতায়ালা এই দু'টির আলোকপ্রভা নিষ্প্রভ করে দিয়েছেন। এ দু'টির প্রভা যদি তিনি নিষ্প্রভ না করতেন তাহলে তা পূর্ব-পশ্চিমের মধ্যে যা কিছু আছে সব আলোকিত করে দিত। -তিরমিজি: ৮৭৮

এ পাথরটি আল্লাহতায়ালার অন্যতম নিদর্শন। এ বিষয়ে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্যে নির্ধারিত হয়েছে, সেটাই হচ্ছে এ ঘর। যা মক্কায় অবস্থিত এবং সমগ্র জগতের মানুষের জন্য বরকতময় ও পথ নির্দেশ (হেদায়েত)। এতে রয়েছে মাকামে ইবরাহিমের মতো প্রকৃষ্ট নিদর্শন। -সূরা আলে ইমরান: ৯৬ ও ৯৭।

আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) বলেন, ‌মাকামে ইবরাহিম দ্বারা উদ্দেশ্য হলো- যে পাথরে তার পদযুগলের চিহ্ন রয়েছে।

আল্লাহতায়ালা কোরআনে কারিমের দুই জায়গায় মাকামে ইবরাহিমের কথা উল্লেখ করেছেন। ওই দুই স্থান হলো- সূরা বাকারা ১২৫ ও সূরা আলে ইমরানের ৯৭ নম্বর আয়াত।

হজরত ইবরাহিম (আ.) এই পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে কাবা ঘর নির্মাণ করেছেন। তার পুত্র হজরত ইসমাইল আলাইহিস সালাম পাথর সংগ্রহ করে এনে এগিয়ে দিতেন। আর তিনি এই পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে কাবা ঘরের দেয়াল নির্মাণ করতেন। এ প্রসঙ্গে বোখারির হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, অতঃপর ইবরাহিম (আ.) বললেন, হে ইসমাইল! আল্লাহ আমাকে একটি কাজের নির্দেশ দিয়েছেন। হজরত ইসমাইল (আ.) বললেন, আপনার রব! আপনাকে যা আদেশ করেছেন, তা করুন। হজরত ইবরাহিম (আ.) বললেন, তুমি আমাকে সাহায্য করবে কি? হজরত ইসমাইল (আ.) বললেন, আমি আপনাকে সাহায্য করবো।

হজরত ইবরাহিম (আ.) বললেন, আল্লাহ আমাকে এখানে একটি ঘর বানাতে নির্দেশ দিয়েছেন।

এই বলে তিনি উঁচু টিলাটির দিকে ইশারা করলেন যে, এর চারপাশে ঘেরাও দিয়ে। তখন তারা উভয়ে কাবা ঘরের দেয়াল তুলতে লেগে গেলেন। হজরত ইসমাইল (আ.) পাথর আনতেন, আর হজরত ইবরাহিম (আ.) নির্মাণ করতেন।

পরিশেষে যখন দেয়াল উঁচু হয়ে গেল, তখন হজরত ইসমাইল (আ.) (মাকামে ইবরাহিম নামে খ্যাত) পাথরটি আনলেন এবং হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর জন্য তা যথাস্থানে রাখলেন। হজরত ইবরাহিম (আ.) তার ওপর দাড়িয়ে নির্মাণ কাজ করতে লাগলেন। আর হজরত ইসমাইল (আ.) তাকে পাথর যোগান দিতে থাকেন। তখন তারা উভয়ে এ দোয়া করতে থাকলেন, হে আমাদের রব! আমাদের থেকে কবুল করুন। নিশ্চয়ই আপনি সব কিছু শুনেন ও জানেন।

তারা উভয়ে আবার কাবা ঘর তৈরি করতে থাকেন এবং কাবা ঘরের চারদিকে ঘুরে ঘুরে দোয়া করতে থাকেন, হে আমাদের রব! আমাদের থেকে কবুল করে নিন। নিশ্চয়ই আপনি সব কিছু শুনেন ও জানের। -সূরা আল বাকারা: ১২৭, -সহিহ বোখারি: ৩১২২

আল্লাহতায়ালা হজ ও উমরাকারীদের মাকামে ইবরাহিমের পেছনে নামাজ আদায়ের নির্দেশ প্রদান দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, হজরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন মক্কা এলেন সাতবার বায়তুল্লাহর তওয়াফ করলেন। তখন তাকে আমি পাঠ করতে শুনেছি, তোমরা মাকামে ইবরাহিমকে নামাজের স্থান হিসেবে গ্রহণ করো।' -সূরা বাকারা: ১২৫

তারপর তিনি মাকামে ইবরাহিমের পেছনে নামাজ আদায় করলেন। -সুনানে তিরমিজি

এই পাথরের ওপরে যে দু'টি পদচিহ্নের মতো গর্ত আছে, সেগুলো ইবরাহিম (আ.)-এর পদচিহ্ন কিনা, এ প্রসঙ্গে উল্লেখিত আয়াতের তাফসির প্রসঙ্গে ইবনে জারির কাতাদা (রা.) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আল্লাহতায়ালা এ পাথরের নিকটে লোকদের নামাজ পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন; হাত দ্বারা মাসেহ করতে বলেননি। কিন্তু এই উম্মত নিজেদের ওপর এমন কিছু কাজ চাপিয়ে নিয়েছে যা পূর্ববর্তী উম্মতগণ করেননি। যাহোক, যারা ওই পাথরের ওপর হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর পায়ের গোড়ালি ও আঙ্গুলের চিহ্ন দেখেছেন, তারা আমাদের কাছে বিবরণ দিয়েছেন। কিন্তু উম্মতের লোকেরা হাত দ্বারা স্পর্শ করতে করতে সেই পাথরের আলোকপ্রভা নিষ্প্রভ হয়ে গেছে এবং শেষ অবধি সেই চিহ্ন মুছে গেছে। -তাফসিরে ইবনে কাসির: ১/১১৭

আর আল্লামা উসমাইমিন (রহ.) বলেন, মাকামে ইবরাহিম সুপ্রমাণিত। এতে কোনও সন্দেহ নাই। এই যে কাচে ঘেরা স্থাপনাটি সেটি মাকামে ইবরাহিম। কিন্তু তার মধ্যে যে গর্তটি রয়েছে তা দেখে মনে হয় না যে, এটি ইবরাহিম (আ.)-এর পদযুগলের চিহ্ন। কেননা এটি ঐতিহাসিকভাবে স্বতঃসিদ্ধ যে, দীর্ঘ কালপরিক্রমায় পদচিহ্ন মুছে গেছে এবং এটি সেখানে গর্ত করা হয়েছে বা কেবল চিহ্নিত করার জন্য বসানো হয়েছে। এটা নিশ্চিত করে বলা যাবে না যে, এ গর্তটিই হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর পা রাখার স্থান।

এই পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে হজরত ইবরাহিম (আ.) হজের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে ফাকেহি ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে করেন, হজরত ইবরাহিম (আ.) কাবা ঘরের নির্মাণ কাজ শেষ করলে আল্লাহ তাকে হজের ঘোষণা দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। অত:পর তিনি মাকামে ইবরাহিমে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিলেন, হে লোকেরা! তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্য একটি ঘর নির্মাণ করেছেন। অতঃএব তোমরা তাতে হজ করো।

তখন পুরুষদের পৃষ্ঠদেশ ও নারীদের গর্ভাশয় থেকে মানুষ তার জবাব দিয়ে বলল, আমরা সাড়া দিলাম, আমরা সাড়া দিলাম। আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, হে আল্লাহ! তোমার দরবারে উপস্থিত। তিনি বলেন, সুতরাং বর্তমানে যত মানুষ হজ করে তারা ওই সব লোক যারা সেদিন ইবরাহিম (আ.)-এর ডাকে সাড়া দিয়েছিল।

পাথরটি হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর যুগ, তারপরে জাহেলি যুগ, রাসূল (সা.)-এর যুগ এবং সর্বশেষ হজরত আবু বকর (রা.)-এর যুগে কাবা ঘরের সঙ্গে লাগানো অবস্থায় ছিলো। পরবর্তীতে উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) একটিকে কাবা থেকে কিছুটা দূরে স্থাপন করেন।

ইমাম বায়হাকি সহিহ সনদে হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, মাকামটি রাসূলুল্লাহ (সা.) ও হজরত আবু বকর (রা.)-এর যুগে কাবা ঘরের সঙ্গে লাগানো ছিল। অত:পর হজরত উমর (রা.) সেটিকে পেছনে নিয়ে আসেন।

এর উদ্দেশ্য ছিল, যেহেতু মাকামে ইবরাহিমের পেছনে নামাজ আদায়ের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে, সেহেতু সেটিকে এমন স্থানে স্থানান্তরিত করা প্রয়োজন যেন, লোকজন সুবিধাজনকভাবে নামাজ আদায় করতে পারে এবং তওয়াফকারীগণও বাধাগ্রস্ত না হয়। ইবনে হাজার আসকালানি (বহ.) বলেন, উমর (রা.)-এর কাজে কোনও সাহাবি প্রতিবাদ করেননি। সুতরাং এটি সাহাবিদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হিসেবে পরিগণিত।

এ সম্পর্কিত আরও খবর