মক্কা (সৌদি আরব) থেকে: অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশি হাজিদের বয়স অনেক বেশি এবং সৌদি আরবের প্রচণ্ড গরম আর খাদ্যাভ্যাসের কারণে প্রচুর হাজি অসুস্থ হয়ে যান। যেহেতু হজপালনের জন্য আর্থিক, শারীরিক ও মানসিক সামর্থ্য জরুরি। কিন্তু অনেক হজযাত্রী আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান হলেও শারীরিকভাবে তেমন একটা সুস্থ থাকেন না। ফলে সহিহ-শুদ্ধভাবে হজের সমস্ত হুকুম-আহকাম আদায় করে অনেকের জন্য হজপালন কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তাই হজযাত্রীদের শারীরিক সামর্থ্য ও সুস্থতার দিকে খেয়াল রাখা দরকার। এক্ষেত্রে যে ব্যক্তি হজে আসবেন, যারা হজে পাঠাবেন, যারা ব্যবস্থা করে নিয়ে আসবেন- তাদের প্রত্যেকের সচেতন হতে হবে। শারীরিকভাবে সুস্থ ও সামর্থ্যবান হলেই কেবল তাকে হজে পাঠানো উচিত। বিশেষ করে বেশি বয়স্ক, হাঁটাচলায় অক্ষমদের হজে পাঠানোর আগে বারবার চিন্তা করা দরকার। যেহেতু হজের বিষয়ে ইসলামের বিকল্প বিধান রয়েছে। সুতরাং জোর করে অসুস্থ ও শারীরিকভাবে অক্ষম কাউকে হজে পাঠানোর কিংবা আসা দরকার নেই বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ হজ চিকিৎসক দলের দলনেতা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাকির হাসান।
বাংলাদেশ হজ মেডিকেল সেন্টারে বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় তিনি এমন মন্তব্য করেন।
তিনি হজযাত্রীদের শারীরিক সামর্থ্যের ওপর জোর দিয়ে বলেন, একটি দলে একজন অসুস্থ হাজি থাকলে সবাইকে এ জন্য কষ্ট পোহাতে হয়।
কেউ হঠাৎ করে অসুস্থ হতে পারেন, সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি জটিল কোনো রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে আবেগতাড়িত হয়ে হজে পাঠানোর আগে আরও চিন্তা-ভাবনা করার পরামর্শ দেন।
সেই সঙ্গে তিনি বলেন, কিডনি রোগী, শ্বাসকষ্ট, ঠাণ্ডা-কাশি, মানসিক রোগী, হাইপারটেনশন, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস ও স্ট্রোকজনিত রোগীদের কেউ হজে এলেও তাদের যথাযথ-প্রয়োজনীয় ওষুধ সঙ্গে রাখতে হবে।
হজ চিকিৎসক দলের এই দলনেতা আরও বলেন, অনেক সময় কোনো কোনো হজ এজেন্সি হাজি সংগ্রহের সময় বলে, আপনার ওষুধপত্র কিছু নেওয়ার দরকার নেই। বাংলাদেশ হজ ক্লিনিক থেকে সব দেওয়া হয়। প্রয়োজন হলে সৌদি সরকার হাজিদের সব ধরনের চিকিৎসা, এমনকি অপারশেনের ব্যবস্থাও করে থাকে। মূলত হাজি সাহেবের খরচ কম দেখানোর মানসিকতা থেকে এমন প্রলোভনের কথা বলা হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো সৌদি আরবের হাসপাতালগুলো একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ সেবা দেয়। সুতরাং হজ ক্লিনিক কিংবা সৌদি সরকার আপনার চিকিৎসা করবে এ মনোভাব বাদ দিয়ে সুস্থ শরীর নিয়ে হজে আসতে হবে। সেই সঙ্গে হাজি সাহেবকেও সচেতন থাকতে হবে খাবার-দাবার নিয়ে। অনেক ডায়াবেটিসের রোগী আসেন, তার ব্লাড সুগারের মাত্রা বেশি। কারণ তিনি পবিত্র জ্ঞান করে মক্কার খেজুর খান, হাজিদের সেবায় দেওয়া খাবার-পানীয় ও জুস পান করেন। অনেক রোগী তো বলেই বসেন, হজে এসে খেজুর খেলে কিছু হয় না শুনেছি! এই যে অসচেতনতা, এটার জন্য কিন্তু নিজেকে বুঝতে হবে, নিজেকে সচেতন হতে হবে। পেলেই ফ্রি খাবার খাওয়া যাবে না। নিয়মিত সেবন করা হয় এমন ওষুধ অবশ্যই সঙ্গে আনতে হবে।
বাংলাদেশ থেকে এবার এক লাখ ২৭ হাজার ১৫২ জন হাজযাত্রী হজপালনের জন্য সৌদি আরব এসেছেন। বাংলাদেশি হজযাত্রীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়ার জন্য মক্কা, মদিনা ও জেদ্দায় তিনটি হজ মেডিকেল সেন্টার স্থাপন করা হয়।
সম্পূর্ণ বিনামূল্যে প্রয়োজনীয় ওষুধসহ এসব মেডিকেল সেন্টার থেকে সোমবার (২৬ আগস্ট) পর্যন্ত এক লাখ ছয় হাজার ১৮৮ জনকে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়েছে। তবে মক্কা মেডিকেল সেন্টার থেকে বেশি সেবা দেওয়া হয়। এ সেন্টার থেকে সোমবার পর্যন্ত ৯০ হাজারের বেশি চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়েছে। তবে হজ ক্লিনিকটি আউটডোর ক্লিনিক হওয়ায় সব রোগের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সেখাসে দায়িত্বরত একাধিক চিকিৎসক। নেই ডায়াবেটিস ছাড়া এক্সরে বা অন্য কোনো ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা। এটা নিয়ে অনেকেই ক্ষুব্ধ।
তবে নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও হাজিদের সর্বোত্তম সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে ক্লিনিকটিতে সার্বক্ষণিক জেনারেল চিকিৎসকের পাশাপাশি রয়েছেন কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। গুরুতর অসুস্থদের পর্যবেক্ষণের জন্য ভর্তি রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। এ ছাড়া কোনো রোগীর অবস্থা জটিল হলে তাকে সৌদি আরবের চারটি স্পেশালাইজড হাসপাতালে পাঠানো হয়।
মক্কা মেডিকেল সেন্টারে ৩৬ জন ডাক্তার, ৩৩ জন নার্স, ব্রাদার্স, টেকনিশিয়ান, ফার্মাসিস্ট তিন শিফটে দায়িত্ব পালন করেন। তাদের সহায়তার জন্য হজ চিকিৎসক দলের ২৬ জন, ছয়জন হজকর্মী ও ছয়জন ড্রাইভার রয়েছেন। রয়েছে তিনটি অ্যাম্বুলেন্স।
বাংলাদেশ হজ মেডিকেল সেন্টারটি মিসফালা রোডে অবস্থিত। মিসফালা রোডের যে এলাকায় বাংলাদেশি হাজিরা থাকেন, ক্লিনিকটি ওই এলাকা বেশ দূরে। এখানেও হাজিরা থাকেন, কিন্তু কম।
এ বিষয়ে হজ চিকিৎসক দলের দলনেতা বলেন, হ্যা, ক্লিনিকটি একটু দূরে। তবে অন্য এলাকায় আরও বেশ কয়েকটি সাব-সেন্টার করার চিন্তা আছে ভবিষ্যতে।
ভবিষ্যতে মিনা ও আরাফাতে চিকিৎসা সেবার পরিধি বাড়ানোর চিন্তা-ভাবনা রয়েছে। এ জন্য সৌদি সরকারের অনুমতি নিতে হবে। খুব বড় আকারের না হলেও অন্তত মিনায় ভ্রাম্যমাণ মেডিকেল টিম করার সুপারিশ রয়েছে। কারণ, মিনায় হাজিদের তিন দিন থাকতে হয়। এ কয়দিন প্রচুর হাঁটতে হয়, সঙ্গত কারণেই এসব স্থানে চিকিৎসক দল থাকা জরুরি।
যেভাবে সেবা দেওয়া হচ্ছে তাতে আপনি সন্তুষ্ট কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. জাকির হাসান বলেন, সন্তুষ্টি তো আপেক্ষিক বিষয়। এর কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। তার পরও আমরা চেষ্টা করছি ভালো কিছু করার।
ভবিষ্যতে হজ চিকিৎসক দলে আরও সব শ্রেণির স্পেশালাইজড ডাক্তার অর্ন্তভুক্তির কথাও বলেন তিনি।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশি হজযাত্রীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়ার জন্য ১০৫ জন চিকিৎসক, ৭৫ জন নার্স, ৪০ জন ফার্মাসিস্ট, ১০ জন ওটি সহকারী ও ল্যাবরেটরি সহকারীসহ মোট ২৩০ সদস্যের হজ চিকিৎসক দল পাঠিয়েছে সরকার। হজ চিকিৎসক দলকে সহায়তার জন্য আরও ১১৮ জনকে পাঠানো হয়েছে। স্থানীয়ভাবেও কিছু হজকর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে মক্কা-মদিনা ও জেদ্দায় দায়িত্ব পালন করছেন।