পবিত্র কোরআনের সূরা মুমিনুনে আল্লাহতায়ালা মুমিনের গুণাবলি তুলে ধরেছেন। ওই সূরায় কয়েকটি গুণের কথা বিশেষভাবে বলা হয়েছে। ওইসব গুণ নিজের ভেতরে ধারণ করতে পারলে ইহকাল ও পরকালে সফলতা অর্জন করা সম্ভব।
মানুষের সফলতা দুই ধরনের। এক. দুনিয়ার সফলতা। অর্থাৎ সৎ পথে উপার্জন করা, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা, হালাল-হারাম মেনে চলা। সর্বোপরি কোরআন-হাদিস অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা।
দুই. পরকালীন সফলতা। হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুপারিশ লাভ করা। আমলনামা ডান হাতে পাওয়া, হাউজে কাউসারের পানি পান করা। পুলসিরাত পার হওয়া, আরশের নিচে স্থান পাওয়া এবং জান্নাত লাভ করা।
কোরআনে কারিমে আরও বলা হয়েছে, ‘যারা পাপ কাজ থেকে বিরত তারাই প্রকৃত সফলকাম।’ -সূরা আলা: ১৪
কোরআনে কারিমে অন্যত্র আরও বলা হয়েছে, ‘তোমরা দুনিয়াকে পরকালের ওপর প্রাধান্য দিয়ে থাকো, অথচ দুনিয়ার তুলনায় পরকাল উত্তম; কারণ সেখানেই আসল সফলতা।’ -সূরা আলা: ১৬-১৭
এখানে মুমিনের গুণাবলি সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো।
মুমিনের প্রথম গুণ ঈমানদার হওয়া। এটি মৌলিক বিষয়। এর পর মুমিনের গুণ হলো, খুশুখুজুসহ (একাগ্রতা) নামাজ আদায় করা। এ বিষয়ে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা নিজেদের নামাজ খুশুখুজুসহ আদায় করে।’ -সূরা মুমিনুন: ২
ইসলামি স্কলাররা বলেছেন, নামাজে খুশুখুজুর অর্থ হলো- স্থির থাকা, অনর্থক নড়চড় না করা। আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর কল্পনাকে অন্তরে ইচ্ছাকৃতভাবে উপস্থিত না করা। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবু যর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহতায়ালা বান্দার প্রতি তার নামাজের দণ্ডায়মান থাকাকালীন পর্যন্ত রহমতের দৃষ্টিপাত করতে থাকেন, যতক্ষণ পর্যন্ত সে অন্যদিকে দৃষ্টিপাত না করে। যখন সে অন্যদিকে দৃষ্টিপাত করে, তখন আল্লাহতায়ালাও তার থেকে রহমতের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেন। -সুনানে নাসায়ি: ১১৯৫
মুমিনের দ্বিতীয় গুণ অনর্থক কথাবার্তা থেকে বিরত থাকা। কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা অনর্থক কথাবার্তা থেকে বিরত থাকে।’ -সূরা মুমিনুন: ৩
অনর্থক কথাবার্তা বলতে অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা। অর্থাৎ যাতে কোনো উপকার নেই, বরং ক্ষতি বিদ্যমান। এর থেকে বিরত থাকা ওয়াজিব। বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যখন অনর্থক বিষয় ত্যাগ করে, তখন ওই ব্যক্তির ইসলাম সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়।
মুমিনের তৃতীয় গুণ জাকাত দেওয়া। ইরশাদ হয়েছে, যারা জাকাত দিয়ে থাকে। -সূরা মুমিনুন: ৪
জাকাত ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের অন্যতম। এটি বিত্তবানদের ওপর ফরজ। শরিয়ত নির্ধারিত সম্পদ এক বছর পূর্ণ হওয়া সাপেক্ষে নির্দিষ্ট শর্তসহ দান করাকে জাকাত বলে। ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর (রা.) জাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। পবিত্র কোরআনে নামাজ এবং জাকাতের কথা ৮২ বার উল্লেখ করা হয়েছে।
মুমিনের চতুর্থ গুণ লজ্জাস্থান সংযত রাখা। ইরশাদ হয়েছে, যারা নিজেদের লজ্জাস্থান সংযত রাখে। -সূরা মুমিনুন: ৫
সাহাবি হজরত সাহল ইবনে সাদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি দুই চোয়ালের মধ্যবর্তী অঙ্গ (জিহবা) এবং দুই পায়ের মধ্যবর্তী অঙ্গ (গুপ্তাঙ্গ) সম্বন্ধে নিশ্চয়তা দেবে, আমি তার জন্য জান্নাতের নিশ্চয়তা দেবো। -সহিহ বোখারি: ৬৪৭৪
পবিত্র কোরআনে নির্দেশিত হারাম নারীকে বিয়ে করা এ বিধানের অন্তর্ভুক্ত। স্ত্রীর সঙ্গে স্রাব চলাকালীন অবস্থায় কিংবা অস্বাভাবিক পন্থায় সহবাস করা, জীব-জন্তুর সঙ্গে মিলন, সমকামিতা ও হস্তমৈথুনও এর অন্তর্ভুক্ত।
মুমিনের পঞ্চম গুণ আমানত রক্ষা করা। পবিত্র কোরআনে মুমিনের গুণ সম্পর্কে বলা হয়েছে, যারা নিজেদের ওয়াদা এবং আমানত রক্ষা করে। -সূরা মুমিনুন: ৮
আমানত দুই ধরনের। এক. আল্লাহ প্রদত্ত, দুই. বান্দা সম্পর্কীয়। আল্লাহ প্রদত্ত আমানত হলো- ক্ষমতা, অর্থ সম্পদ এবং মানবদেহের প্রতিটি অঙ্গের সদ্ব্যবহার করা। আর বান্দা সম্পর্ক আমানত হলো- কেউ টাকা-পয়সা গচ্ছিত রাখলে তা যথাসময়ে বুঝিয়ে দেওয়া, কেউ কোনো গোপন কথা বললে অবশ্যই তা গোপন রাখা। অধীনস্থ কর্মচারীদের পাওনা যথাসময়ে দিয়ে দেওয়া। কর্মচারীকে মালিকের কাজ সঠিকভাবে আদায় করা।
মুমিনের ষষ্ঠ গুণ ওয়াদা রক্ষা করা। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, (মুমিনগণ) ওয়াদা করলে তা পূর্ণ করে। -সূরা মুমিনুন: ৮
অঙ্গীকার বলতে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি বুঝায়, যা কোনো ব্যাপারে উভয়পক্ষ অপরিহার্য করে নেয়। এরূপ চুক্তি পূর্ণ না করা প্রতারণার শামিল। এটা হারাম কাজ। আরেক প্রকার অঙ্গীকার হলো, একতরফাভাবে একজন অন্যজনকে কিছু দেওয়া অথবা অন্যজনের কোনো কাজ করে দেওয়ার চুক্তি করা। হাদিসে বলা হয়েছে, ওয়াদা একপ্রকার ঋণ। আর এ ঋণ আদায় করা যেমন ওয়াজিব, ওয়াদা পূরণ করাও তেমন ওয়াজিব। শরিয়তের কোনো কোনো কারণ ছাড়া এর খেলাপ করা কবিরা গোনাহ।
মুমিনের সপ্তম গুণ নামাজে যত্নবান হওয়া। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, তারা (মুমিনগণ) নিজেদের নামাজে যত্নবান। -সূরা মুমিনুন: ৯
নামাজে যত্নবান হওয়ার অর্থ হলো- নামাজ যথাসময়ে যথানিয়মে আদায় করা। পবিত্র কোরআনের সূরা মাউনে বলা হয়েছে, ধ্বংস ওইসব নামাজির, যারা তাদের নামাজে বেখবর। -সূরা মাউন: ৪-৫
নামাজের ব্যাপারে উদাসীনদের কঠিন ধমক ও জাহান্নামের হুমকি দেওয়া হয়েছে। লক্ষণীয় যে, বর্ণিত সাতটি গুণের শুরু এবং শেষ উভয়টা হয়েছে নামাজ দিয়ে। এর থেকে বুঝা যায়, নামাজের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। একজন মানুষ যখন আরকান-আহকামসহকারে নামাজ আদায় করে তখন তার অন্য কাজগুলো আপনা আপনি ঠিক হয়ে যায়।
উল্লেখিত গুণসম্পন্ন মুমিনদের সুসংবাদ জানিয়ে আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, তারাই উত্তরাধিকারী লাভ করবে এবং জান্নাতুল ফেরদাউসের বাসিন্দা হবে, সেখানে তারা থাকবে চিরকাল। -সূরা মুমিনুন: ১০-১১
এখানে উত্তরাধিকারী বলার কারণ হলো, মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি যেমন উত্তরাধিকারীদের মালিকানায় আসে। তেমনি জান্নাত নামক সম্পত্তিতে আমাদের উত্তরাধিকারের অংশ রয়েছে। আমাদের উত্তরাধিকারীরা হলেন- নবী-রাসূলগণ। আমরা যদি উত্তরাধিকারীদের রেখে যাওয়া পথে চলতে পারি, তাহলে আমরা আমাদের উত্তরাধিকারীদের সম্পত্তি তথা জান্নাত লাভ করবো- ইনশাআল্লাহ।