আরবি রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ আজ। তারিখে হিসেবে আজকের দিনে রাহমাতুল্লিল আলামিন হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম ও ওফাত দিবস। দিনটি মুসলিম উম্মাহর কাছে পবিত্র নবী দিবস হিসেবে বেশি পরিচিত। বছর পরিক্রমায় আজ আবার আমাদের মাঝে এসেছে এ দিবস। দিনটি শুধু মুসলিম উম্মাহর জন্য নয়, বরং গোটা বিশ্বমানবতার জন্য অসাধারণ তাৎপর্য ও গুরুত্ব বহন করে।
আমরা শেষ নবীর উম্মত। শেষ নবীর উম্মত হওয়া যেমন সৌভাগ্যের বিষয়, তেমনি তার জীবনাদর্শ প্রাপ্তিও একটি সৌভাগ্যের বিষয়। কেননা তিনি সেই মহান ব্যক্তিত্ব যার মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা নবুওয়তের মতো মস্তবড় নিয়ামতের পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছেন। তারপর আর কোনো নবী আসবেন না। তিনিই আখেরি নবী। ইহ-পারলৌকিক মুক্তির সনদ বিশ্ব মানবের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত শেষ ও পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা ইসলাম নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে এসেছে। কাজেই পৃথিবীতে সেসব মানুষই সবচেয়ে বেশি ভাগ্যবান, যারা এ জীবন বিধানের যথার্থ অনুসারী এবং নিজ ব্যক্তি ও সমষ্টি জীবনে আল্লাহর রাসূল ও তার সাহাবাদের অনুকরণে ইসলামী জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজেদের জীবন অতিবাহিত করতে সক্ষম।
এদিক থেকে পবিত্র নবী দিবস একটি আত্মজিজ্ঞাসার দিন। এদিন প্রতিটি মুসলমানের কর্তব্য হলো, আল্লাহতায়ালা মানুষের ইহ-পরকালীন মুক্তি, কল্যাণ ও পুরস্কারপ্রাপ্তির জন্য মহানবীকে (সা.) যে ‘উসওয়ায়ে হাসানা’ বা সুন্দরতম আদর্শ নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন আমাদের জীবনকে সে আদর্শ মাফিক জীবন গড়ে তোলা। বিপরীত ধারায় যেয়ে জীবন পরিচালিত করে শয়তানকে খুশি না করা।
বলতে দ্বিধা নেই, আজকের প্রেক্ষিতে এমন আত্মজিজ্ঞাসার প্রয়োজন তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছে নানা কারণে। প্রথমতঃ বাংলাদেশ একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। এই দেশের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের যেকোনো স্তরে যার যে দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব, সে সব জায়গায় বা স্তরে আল্লাহর বিধান ও নবীর আদর্শের ব্যতিক্রম কিছু ঘটলে- ওই স্তরের কর্তৃত্বশীলরা দায়ী হন, জনগণের কাছে এর জবাব দিতে হয়। অনুরূপভাবে ঊর্ধ্বতন নীতি নির্ধারক যারা রয়েছেন, তাদেরও সামাজিক অনাচার, অন্যায় ও নবী আদর্শবিরোধী কোনো কাজের জন্যে দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়। এমতাবস্থায় প্রতি বছর নবী দিবস ও এ জাতীয় বিভিন্ন ধর্মীয় দিবস ও উপলক্ষে দায়িত্বশীলরা তাদের ভাষণ ও বাণীতে অনেক নীতিবাক্য উচ্চারণ করেন। যা শুনে জাতি তৃপ্তি অনুভব করেন।
কথা হলো, এভাবে শুধু নবী আদর্শের কথা বলে, অনাচার-দুর্নীতির বিরুদ্ধে বাণী দিয়ে দায়িত্ব শেষ মনে করলে চলবে? আমরা মনে করি, প্রদেয় বাণী ও নীতিবাক্যমাফিক দেশে কাজ হলে সমাজের অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পেতো না, জনদুর্গতিও দিন দিন বাড়তো না। এই আত্মজিজ্ঞাসা এখন বেশি প্রয়োজন।
সামগ্রিক আত্মজিজ্ঞাসার দ্বিতীয় কারণটি হলো, এ ভূখণ্ডের সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসী মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও নানা কারণে অনেকেই ইসলামকে পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থার বদলে খণ্ডিত জীবনব্যবস্থা বলে মনে করেন। ইসলাম সম্পর্কে এমন অগভীর চিন্তার শিক্ষিতদের কথা দূরে থাক দ্বীনের খাদেম অনেক নিষ্ঠাবান আলেমও কার্যত এটাই মনে করেন। ফলে এটি আজ আনুষ্ঠানিক কার্যাবলীবিশিষ্ট তথাকথিত ধর্মে পরিণত হয়ে গেছে এবং কতিপয় নির্দেশ পালন ব্যতীত জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রের যেসব বিষয় কোরআনে কারিম ও নবী জীবনের আদর্শে রয়েছে, সেগুলো আমলের কোনো ব্যবস্থা হয় না। বিশেষ করে দেশের বিচার বিভাগ, আইন-আদালত, অর্থনীতি, শিক্ষানীতি, রাজনীতি ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়ে ইসলামি বিধান বাস্তবায়নের প্রতি কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না।
মানুষের এমন মনোভাব প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর নিকট একমাত্র ইসলামই মানুষের জীবন ব্যবস্থা। ইসলাম ছাড়া জীবন ব্যবস্থা হিসেবে কেউ অন্য কিছু অন্বেষণ করলে তা কখনও গ্রহণযোগ্য হবে না।’ এমনকি আমরা বর্তমানে যেভাবে খণ্ডিত ও আংশিকভাবে ইসলাম পালন করছি, এটাও আল্লাহর বাণীর আলোকে চিন্তা করলে দেখা যায়, তার পছন্দনীয় নয়। যেমন কোরআনে কারিমে আল্লাহতায়ালা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন, ‘তোমরা কি আমার বিধানগ্রন্থের কিছু অংশ বিশ্বাস করো, আর কিছু অংশ অবিশ্বাস করো?’ সুতরাং মুসলমান কিছুতেই ইসলামকে খণ্ডিতভাবে পালনে সন্তুষ্ট থাকতে পারে না। বিশেষ করে যেখানে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং নিজেরাই আইনপ্রণেতা এবং শাসন-প্রশাসনের কর্মকর্তা, সেখানে তাদের বিশেষভাবে সচেষ্ট হওয়া উচিত, যেন ইসলাম ও নবী জীবনের পরিপূর্ণভাবে অনুসারী আমরা হতে পারে।
বলাবাহুল্য, নবী দিবসে যদি সর্বস্তরের মানুষ মহানবীর আদর্শে ও মূল্যবোধে নিজেদের ব্যক্তি ও সমাজ কাঠামো গড়ে তোলার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করে, তাহলে অতি স্বল্প সময়ে এই দেশ ও সমাজকে শোষণমুক্ত আদর্শ সমাজে পরিণত করতে সক্ষম হবো। যে সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন হজরত মুহাম্মদ (সা.)।
আমরা জানি, মুসলিম উম্মাহ এখন শত সহস্র সমস্যায় জর্জরিত। কিন্তু এটা নিয়ে ভয় পেলে চলবে না। আল্লাহতায়ালা মানবজাতিকে মুক্তির পথে আহবান জানানোর দায়িত্ব দিয়েছেন শ্রেষ্ঠ উম্মত হিসেবে আমাদেরকে। সুতরাং চলমান অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হলে সবাইকে ফিরে যেতে হবে মহানবীর (সা.) শিক্ষা ও আদর্শের দিকে। তাহলেই কেবল মানবতা খুঁজে পাবে শান্তি ও মুক্তির পথ। এবারের ১২ রবিউল আউয়ালে এটাই হোক মুসলিম উম্মাহর দৃপ্ত শপথ।