কোরআনে কারিমের বিভিন্ন স্থানে বড় বড় অনেক নাফরমানির কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং এগুলোর ভয়াবহ পরিণামের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, আল্লাহতায়ালার সঙ্গে শরিক করা, মা-বাবার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা, মিথ্যা বলা, আল্লাহর পথে আহ্বানে বাধা দেওয়া, সুদে লেনদেন করা, জুলুম-অত্যাচার করা, মানুষকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা, মানুষের বৈধ অধিকার কেড়ে নেওয়া, এতিমের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করা, আত্মীয়তার সম্পর্ক নষ্ট করা, কৃপণতা করা ও ওজনে কমবেশ করা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
কিন্তু এগুলো থেকে আরও মারাত্মক ও ভয়াবহতার সঙ্গে আল্লাহতায়ালার ক্রোধকে উসকে দেয় অর্থাৎ আল্লাহর বিশাল রাগের কারণ হয় যেই কাজটি, তা হলো- ‘নিজে যা করে না, তা বলে বেড়ানো।’
কোরআনে কারিমের সূরা সফের ২ ও ৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা এমন কথা কেন বলো, যা নিজেরা করো না? আল্লাহর কাছে এটা অত্যন্ত অপছন্দনীয় কাজ যে, তোমরা এমন কথা বলো যা করো না।’
সূরা সফের এ আয়াতটির অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট যাই থাক না, এটি একটি সাধারণ বিষয় যা সব মানুষের বেলায় সমভাবে প্রযোজ্য। আর এ জন্যই পৃথিবীর সব মানুষের কাছে এটি একটি ঘৃণার বিষয়। যারা বেশি বলে, বেশি লিখে, বেশি বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে বেড়ায়, অথচ তাদের চরিত্রে পাওয়ারি গ্লাস ব্যবহার করেও এগুলোর কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না। বরং অনেক ক্ষেত্রে উল্টো চিত্র বেশি করে পরিলক্ষিত হয়। তখন সে আল্লাহর বিশাল ক্রোধে নিপতিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর সব ব্যক্তি মানুষেরও ঘৃণার পাত্রে পরিণত হতে হয়। জীবন চলার পথে এমন চরিত্রের মানুষ প্রচুর রয়েছে। এদের মধ্যে যেমন সাধারণ মানুষ আছে তেমনি আছে অনেক বিখ্যাত লেখক, কবি, সাহিত্যিক, আলেম, পীর, মুফতি, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, সরকারি ও বেসরকারি আমলা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বড় বড় পদবিধারী ব্যক্তি।
লেবাসে-চেহারায় কেতাদুরস্তভাব, বাইরের থেকে অনেক বড় কিছু মনে হয়। কিন্তু একান্ত কাছাকাছি এলে তার ভেতরকার কুৎসিত চেহেরা বেরিয়ে আসে। এভাবে সমাজের অনেক বক্তার শত শত জ্ঞানগর্ব আলোচনা ও উপদেশবাক্য শোনা যাবে, কিন্তু তার ব্যক্তি চরিত্রে এ আলোচনা ও উপদেশের মিল খুঁজে পাওয়া আপনার জন্য দুরূহ হবে।
এ শ্রেণির মানুষগুলো প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর ক্রোধকে খুব কমই পরোয়া করে। তারা মনে করে, তাদের লেবাস দেখেই আল্লাহ মাফ করে দেবেন অথবা কথা ও কাজে অমিল থাকলেও অন্যান্য মহৎ কাজের জন্য তারা ছাড়া পেয়ে যাবে। সত্যিকার অর্থে এরা মানুষকে ধোঁকা দিয়ে সস্তা বাহবা খুঁজে ফেরে।
একজন খাঁটি মুসলমানের চরিত্র এমনটি হওয়ার কথা নয়। একজন মুসলমানের কথা ও কাজে মিল থাকা উচিত। সে যা বলবে তা করে দেখাবে, আর করার সৎ সাহস না থাকলে তা মুখেও আনবে না।
আগেই বলা হয়েছে যে, এ রকম কথা বলা ও অন্য রকম কাজ করা আল্লাহর দৃষ্টিতে যেমন অত্যন্ত ঘৃণিত তেমনি মানুষের কাছেও জঘন্য ঘৃণিত কাজ হিসেবে চিহ্নিত হয়। যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ঈমান পোষণ করার দাবি করে তার পক্ষে এমন নৈতিক দোষ ও বদ স্বভাবে লিপ্ত হওয়া আদৌ সম্ভব নয়।
নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তির মধ্যে এরূপ স্বভাব থাকা প্রমাণ করে যে, সে মুমিন নয় বরং মুনাফিক। কারণ তার এই স্বভাব বা আচরণ মুনাফিকির একটি স্পষ্ট আলামত।’
‘যা করে না তা বলে বেড়ানো’ আল্লাহতায়ালার বিশাল ক্রোধের কারণ হওয়ার পেছনে আরও যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে। এমন স্বভাবের লোক একই সঙ্গে আরও কতগুলো বড় বড় গোনাহের কাজে লিপ্ত হয়।
এক. প্রথমত তাকে একজন বড় মাপের মোনাফিক হতে হয়। তাকে মিথ্যার মতো একটি কবিরা গোনাহের আশ্রয় নিতে হয়। মোনাফিকের লক্ষণের মধ্যে একটি হলো- মিথ্যা বলা।
দুই. এদের ঈমান অবশ্যই ত্রুটিপূর্ণ। একজন প্রকৃত ঈমানদার আল্লাহতায়ালার চরম গোস্সা কুড়াবেন তো দূরের কথা বরং আল্লাহতায়ালার সামান্যতম অসন্তুষ্টির কারণ হতে পারে, সে ধরনের কাজের ধারে কাছে তিনি যেতে পারেন না।
তিন. এ ধরনের লোক সাধারণত লোক দেখানো কাজ করতে বেশি ভালোবাসে। মানুষের সস্তা বাহবা কুড়ানোর জন্য বা বাণিজ্যিক ফায়দা লুটার জন্য সদায় ব্যস্ত থাকে। তার বক্তব্য বা লেখনীর মাধ্যমে অন্তত দু’টি মানুষ সংশোধন হয়ে উঠুক বা একটি সৎ সমাজ গড়ে ওঠার জন্য তার মেধা সামান্যতম অবদান রাখুক, তা তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হয় না। এ আশা তাদের থেকেই করা যায় ‘যারা প্রথমত নিজে আগে আমল করে, পরে মানুষকে তার দাওয়াত দেয়।’
চার. আল্লাহর চরম গোস্সা তো তারাই বহন করে বেড়াতে পারে, যারা চরম বেপরোয়া বা চরম উদাসীন। সুতরাং যারা নিজেরা করে না, কিন্তু বলে বেড়ায়, তারা অবশ্যই বেপরোয়া ও চরম উদাসীন প্রকৃতির মানুষ।